তপন কুমার বিশ্বাস, ইসলামপুর: মদের দোকান বন্ধ। মদের কালোবাজারি তুঙ্গে। তাই মদের বিকল্প হিসাবে চোলাইয়ের দিকে ঝুঁকছে ইসলামপুরের মদ্যপ্রেমীদের একাংশ।
শহর সংলগ্ন আদিবাসী মহল্লায় জোর কদমে চলছে চোলাই তৈরির কাজ। আবগারি দপ্তর অবশ্য দাবি করেছে, তারা নিয়মিত অভিযান চালায়। তারপরও চোলাইয়ের রমরমা বৃদ্ধিতে প্রমাদ গুণছে বিভিন্ন মহল। আড়ালে আবডালে নয়, প্রকাশ্যে তৈরি হচ্ছে চোলাই।
ইসলামপুর শহর সংলগ্ন বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে ঘুরলে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়বে এমন দৃশ্য। নোংরা পরিবেশ আর ক্ষতিকর উপাদানে তৈরি চোলাই মদ এমনিতেই শরীরে পক্ষে খারাপ। তার উপর নেশার মাত্রা বাড়াতে ইদানিং তাতে মেশানো হচ্ছে আরও নানা রাসায়নিক। ফলে বিপদের সম্ভাবনা ক্রমশই বাড়ছে বলে অভিমত ওয়াকিবহাল মহলের।
আরও খবর: মাস্ক না পড়ে রাস্তায় বেরোলেই গ্রেফতার, মুম্বইয়ে নয়া নির্দেশিকা
আবগারি দপ্তর ও চোলাই উৎপাদনকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, চোলাই মদ মূলত ইথাইল অ্যালকোহল। মদের আকর্ষণ বাড়াতে ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে পিরিডিন জাতীয় জৈব খার, মিথানল, ইউরিয়া এমনকি কীটনাশক বিষও মিশিয়ে দেওয়া হয়। ফলে চোলাই খাওয়ার পর অল্প সময়েই নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছে।
নেশার বহর বাড়তেই বেড়ে চলেছে খদ্দের সংখ্যাও। আগে থেকেই প্রচুর পরিমাণে চোলাইয়ের খদ্দের ছিল। কিন্ত লকডাউনের প্রভাবে মদের কালোবাজারি বৃদ্ধি পাওয়াতে মদ অনেকের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। তারা ঝুঁকছে চোলাইয়ের দিকে।
মদ ছেড়ে চোলাই ধরলেও চোলাই ছেড়ে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন বলে মত চোলাইপায়ীদের একাংশের। ফলে বিষাক্ত এই মদের জেরে শরীরে থাবা বসাতে পারে নানা মারণ রোগ। পূর্বে অভ্যাসবশত যারা চোলাই খেতেন তাদের চোখ নষ্ট হচ্ছে। এমনকি অনেক সময়ই নেমে আসছে মৃত্যু। চোলাইয়ের শিকার যারা, তারা অনেকেই এসব জানেন। তবু ছাড়তে পারেন না। অনেকে আবার এসব জানেনও না। সামান্য সুখের হাত ধরে দিনের পর দিন নেশার বিষ শরীরে ঢুকে চলেছে।
এদিকে ইসলামপুর আবগারি দপ্তরের আধিকারিক মাসুদ আলম বলেন, অভিযোগ একেবারে মিথ্যে নয়। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি ইসলামপুরে চোলাই বন্ধ করতে। নিয়মিত অভিযান চালানো হয়।
আরও খবর: গ্যারগান্ডা চা বাগানে খাঁচাবন্দি চিতাবাঘ
ইসলামপুর সংলগ্ন মিশন পাড়া, মিলনপল্লি, রুইয়া সহ একাধিক আদিবাসী পাড়ায় গৃহস্থ বাড়ির মাটির উনুনে বড় হাঁড়িতেই চোলাই তৈরি হয়। ওইসব গ্রামে চোলাই তৈরি হয় নিম্নমানের চালের ভাত দিয়ে। তারপর তাতে বাখড় মিশিয়ে দেওয়া হয়। বাখড় হল এক ধরনের মিষ্টি, যা মূলত চোলাইয়ে ইস্ট-এর কাজ করে। অর্থাৎ চটজলদি ভাত পচাতে সাহায্য করে। ভাত পচে গেলে একটি বড় হাঁড়িতে বসিয়ে তা ফের ফোটানো হয় উনুনে। ওই হাঁড়ির ওপরে বসানো হয় আরও একটি হাঁড়ি। পচা ভাতের বাষ্প পাইপের মাধ্যমে ফোঁটা ফোঁটা করে জমা হয় জারিকেনে বা বোতলে। এটাই হচ্ছে চোলাই মদ বা ইথাইল অ্যালকোহল। কেউ কেউ আবার পচা ভাতের বদলে চিটে গুড় বা চিনির গাদার সঙ্গে বাখড় মিশিয়ে তৈরি করেন চোলাই।
এখন নেশার বহর বাড়িয়ে এই মদের খদ্দের বাড়াতে এর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে নানা রকমের রাসয়নিক দ্রব্য। ইউরিয়া, পিরিডিন থেকে মিথানল মিশিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান উৎপাদনকারীরা।
এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক শরীরে ঢুকলে অসুস্থতা স্বাভাবিক। চোখ, যকৃতের অসুখ থেকে ক্যান্সারের মতো যে কোনও ভয়ঙ্কর রোগই সহজে অনুপ্রবেশ করতে পারে। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে মৃত্যু হতে পা্রে বলে জানান মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক নুর আলম আনসারি।
তবে এই বিষয়ে ইসলামপুর মহকুমা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক উজ্বল রায় বলেন, ‘আমি চিকিৎসক। চিকিৎসা করি। এই বিষয়ে আমার কোন অভিমত নেই। মিথানল চোখের দৃষ্টি নষ্ট করে। স্নায়ুর উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এই রাসায়নিক।’
মাটিকুন্ডা হাইস্কুলের রসায়নের শিক্ষক দেবজিৎ ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘ইউরিয়া সহজেই রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়। গাঁটবাত দেখা দেবে এবং পিরিডিন সরাসরি হার্ট, কিডনিতে প্রভাব ফলে। শরীরের নানা অংশে ক্ষতের করে। এর জেরে অনান্য রোগের সঙ্গে অঙ্গহানির প্রবণতাও দেখা যায়।’