রাজশ্রী প্রসাদ, পুরাতন মালদা : কৃষক বাজারে সহায়কমূল্যে ধান বিক্রি করতে রীতিমতো তোলা দিতে হচ্ছে। পুরাতন মালদায় এমনই অভিযোগ তুললেন কৃষকরা। ধান বিক্রি করতে আসা কৃষকদের অভিযোগ উঠেছে, ধান বিক্রির জন্য লাইনে গাড়ি দাঁড় করাতে গেলে প্রতিটি গাড়ির জন্য দশ টাকা করে দিতে হচ্ছে কৃষকদের। কিন্তু ওই টাকার জন্য কোনো পাকা রসিদ দেওয়া হচ্ছে না। আরও অভিযোগ উঠেছে, ভোর থেকে লাইন দিলেও ধান না কিনে কৃষকদের মিলে গিয়ে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা। বুধবার ধর্মঘটের দিনে এমনই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন পুরাতন মালদার বহু কৃষক। এবিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিডিও।
সরকারি সহায়কমূল্যে ধান বেচার জন্য ভোর তিনটে থেকে কৃষক বাজারে লাইন দিয়েছিলেন যাত্রাডাঙার কৃষক আবদুর রহিম। তাঁর মতোই ভোর থেকে ট্র্যাক্টর বোঝাই ধান নিয়ে লাইন দিয়েছিলেন যাত্রাডাঙার সাজিদুর রহমান, পোপড়ার প্রসেনজিৎ সাহা, মহিষবাথানির আমিরুল ইসলাম, কামঞ্চর তাপস রাজবংশী ও চন্দন মুর্মুর মতো কৃষকরা। তবে শুরুতেই হোঁচট খেতে হয় তাঁদের। অভিযোগ, ধানবোঝাই গাড়ি লাইনে দাঁড় করানোর জন্য কৃষক বাজারে এক ব্যক্তি রসিদ ছাড়াই প্রতি গাড়ি পিছু দশ টাকা করে তোলা আদায় করছিলেন। নিজেকে কিষান মাণ্ডির নিরাপত্তারক্ষী বলে ওই ব্যক্তি দাবি করেন বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, সাদা কাগজে সিল মেরে তাতে লাইনের নম্বর লিখে দিচ্ছিলেন তিনি। বাজারে উপস্থিত প্রায় পঞ্চাশটি গাড়ি থেকে শ-পাঁচেক টাকা এভাবেই আদায় করা হয় বলে অভিযোগ।
কৃষকদের বক্তব্য, এরপর আরও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। ভোর তিনটে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে বিকেল চারটে পেরিয়ে গেলেও বহু কৃষকের ধান কেনা হয়নি। বরং ধর্মধটের কারণ দেখিয়ে সরাসরি মিলে গিয়ে ধান বিক্রির কথা বলেছেন কৃষক বাজারের পারচেজ অফিসার। স্বভাবতই, ধানের পরিবহণ খরচ তাতে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। কুইন্টাল পিছু পনেরো টাকা লেবার চার্জ, তিন থেকে চার কিলো ধলতা এবং পঞ্চাশ টাকা ধরমকাঁটার খরচ ধরায় লোকসান হয়েছে বলেও অভিযোগ কৃষকদের। গড়পড়তা বাইরের ফড়েদের থেকেও কম দাম পাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন কৃষকরা।
পোপড়ার চাষি প্রসেনজিৎ দাস বলেন, ট্র্যাক্টর বোঝাই ধান নিয়ে ভোর তিনটেয় কৃষক বাজারে আসি। তখনই গাড়ি পিছু দশ টাকা করে তোলা নেন গেটের রক্ষী। তোলা না দিলে লাইনে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। একটা সাদা কাগজে সিল দিয়ে লাইনের নম্বর লিখে দিচ্ছিলেন ওই রক্ষী। ভোর থেকে দাঁড়িয়ে এখন বিকেল তিনটে বাজে। কিন্তু ধান নিল না। অফিসার বলছেন, মিলে গিয়ে ধান বিক্রি করতে হবে। এত টাকা খরচ করে গাড়ি ভাড়া করে কৃষক বাজারে ধান নিয়ে এলাম। এখন আবার মিলে যেতে গেলে খরচ দ্বিগুণ বাড়বে। এর থেকে ফড়েকে ধান বিক্রি করা ভালো ছিল।
সাজিদুর রহমান নামে অপর এক কৃষক বলেন, পঁয়তাল্লিশ কুইন্টাল ধান নিয়ে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছি। এখনও ধান নিল না। মিলে যেতে বলছে। এতে খরচ বেড়ে য়াচ্ছে। মিলে ধান বেচে চেক নিতে আবার কৃষক বাজারে আসতে হচ্ছে। সরকার তো আমাদের কথা মাথায় রেখেই এই ব্যবস্থা চালু করেছে। এখন এখানে এসে যদি এত খরচ দিতে হয়, তাহলে আমাদের পথে বসতে হবে। একই অভিযোগ জানান চন্দন মুর্মু, তাপস রাজবংশী, আমিনুল শেখের মতো কৃষকরা। খোদ কৃষক বাজারের মধ্যে লাইনে দাঁড়াতে কেন দশ টাকা করে তোলা দিতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে কৃষক বাজারের পারচেস অফিসার তোফায়ে শেখ বলেন, এমন কোনো টাকা নেওয়া হচ্ছে না। তাঁকে সাদা কাগজে সিল দেওয়া চিরকুট দেখালে তিনি সাফাই দেন, আপনারা আমাকে কেন বিষয়টি জানাননি। ওই সিল আমাদের নয়। যদিও কৃষক বাজার চত্বরে তাঁদের উপস্থিতিতে এমন তোলাবাজি চলছে কীভাবে, তার সদুত্তর মেলেনি। এমনকি যে নিরাপত্তারক্ষীর বিরুদ্ধে তোলা নেওয়ার অভিযোগ, তাঁকেও খুঁজে পেলেন না পারচেজ অফিসার। এতবড়ো কৃষক বাজারে নিরাপত্তারক্ষীই বা কেন বেপাত্তা, তারও জবাব তাঁর কাছে পাওয়া যায়নি।
কৃষকদের কাছে ধান না কিনে কেন তাঁদের মিলে যেতে বলছেন? এর উত্তরে তোফায়েবাবু বলেন, দীর্ঘক্ষণ লাইনে থাকতে হচ্ছে, দেখে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম। জোর করিনি। কিন্তু তাতে তো কৃষকদের পরিবহণ ব্যয় বেড়ে যাবে? এমন প্রশ্নেরও সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। এদিকে কুইন্টাল পিছু পনেরো টাকা লেবার চার্জ নেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাঁর পুরো দায় চাপান শ্রমিকদের ওপরে। এক্ষেত্রে তাঁর কিছু করার নেই বলে জানিয়ে দেন। এদিকে বিষয়টি নিয়ে পুরাতন মালদার বিডিও ইরফান হাবিব বলেন, এমন হয়ে থাকলে, তা অন্যায়। কৃষকরা লিখিত অভিযোগ করলে কড়া ব্যবস্থা নেব।