কলকাতা : গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না- প্রবাদটা বাঙালি বিজ্ঞানী অমল রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রে হয়তো খাটে। রজার পেনরোজ এবার পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর প্রয়াত এই বিজ্ঞানীর নামটা ইতিউতি শোনা যাচ্ছে। ২০২০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেয়েছেন রজার পেনরোজ সহ তিন বিজ্ঞানী। ৮৯ বছর বয়সি পেনরোজ পুরস্কারটি পেয়েছেন স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের তৈরি সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ব্যাখ্যায় কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে। আটের দশক থেকে বহু আলোচিত নাম রজার পেনরোজ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই দ্য এম্পেরর্স নিউ মাইন্ড : কনসার্নিং কম্পিউটার্স, মাইন্ডস অ্যান্ড দ্য লজ অফ ফিজিক্স-এর সুবাদে বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসুদের মনোজগতে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তিনি। একাধিকবার কলকাতায় এসেছেন পেনরোজ। এই শহরের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ আরও নিবিড় হল নোবেল জয়ে মধ্য দিয়ে কারণ, মহাকাশের কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রবাদপুরুষ স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে পেনরোজের যে কাজ, যা নিয়ে তাঁর ব্যাপকতর গবেষণা এবং শেষ পর্যন্ত এই নোবেল স্বীকৃতি, তা দাঁড়িয়ে আছে যে সমীকরণের ওপর, তার স্রষ্টা খাস কলকাতার বাসিন্দা এক বাঙালি। নাম অধ্যাপক অমলকুমার রায়চৌধুরী।
২০০৫ সালে প্রয়াত এই পদার্থ ও বিশ্বতত্ত্ববিদের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে ১৯২৩ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও আশুতোষ কলেজ সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন অমলকুমার রায়চৌধুরী। আপেক্ষিকতার বিশ্বতত্ত্ব সংক্রান্ত রায়চৌধুরী সমীকরণ তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ পেনরোজ-হকিং সিঙ্গুলারিটির তত্ত্বসমূহ প্রমাণের জন্য তাঁর এই সমীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। প্রফেসার রায়চৌধুরীর ছাত্র, পুনের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাকেন্দ্রের প্রধান সোমক রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে তাঁর পদবি এবং তিনি কলকাতা থেকে এসেছেন শুনে অধ্যাপক পেনরোজ জানতে চেয়েছিলেন, তিনি অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর কেউ হন কি না। রজার পেনরোজ এবং স্টিফেন হকিং, দুজনেই নানা সময়ে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তাঁদের গবেষণায় অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর গাণিতিক সূত্রের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন ছাপার অক্ষরে।
আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যার জগতে মনে করা হয় যে, স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটির পর, তার বিস্তৃততর ব্যাখ্যায় এই রায়চৌধুরী ইকুয়েশন দ্বিতীয় যুগান্তকারী সমীকরণ। তাহলে কি পেনরোজের আগে এক বাঙালির হাতে নোবেল পুরস্কার ওঠা উচিত ছিল? বিজ্ঞানী অমল রায়চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র অধ্যাপক অমিতাভ রায়চৌধুরী সেই জল্পনা নস্যাৎ করে বলেন, আমাদের দেশে বসে কোনও কাজ করলে বিদেশে তার স্বীকৃতি পেতে দেরি হয় বটে, তবে কাকার ক্ষেত্রে তা হয়নি। হয়েছে উলটোটাই। অমল রায়চৌধুরীর কাজটা বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছিল বহুকাল আগে, সেই ১৯৫৫ সালে। সত্যি বলতে কী, এদেশে ও নিয়ে তখন কেউ আলোচনা করার মতো ছিল বলেই মনে হয় না। স্টিফেন হকিংয়ের পিএইচডি গবেষণাপত্রে রায়চৌধুরী ইকুয়েশন-এর উল্লেখ রয়েছে বলে জানিয়েছেন অমিতাভবাবু। তিনি বলেন, মূলত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্তবিষ্ণু নার্লিকারের উদ্যোগে ভারতে প্রথম জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার আলোচনায় রায়চৌধুরী ইকুয়েশন মান্যতা পায়। আবার তাতে আলো পড়ল পেনরোজের নোবেল প্রাপ্তিতে। বিদেশ থেকে স্বীকৃতি না পেলে ঘরের প্রতিভাকে কে কবে মনে রেখেছে!