সৌরভ দেব, জলপাইগুড়ি : সকলের তরে সকলে আমরা / প্রত্যেকে মোরা পরের তরে- কামিনী রায়ের এই কবিতার লাইনটি যে যথার্থই তা আরও একবার প্রমাণ করলেন উত্তর চব্বিশ পরগনার সোদপুরের কমল দাস। এই লকডাউন পরিস্থিতিতেও ৬০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে জলপাইগুড়িতে এসে জীবনদায়ী ওষুধ দিয়ে গেলেন অপরিচিত এক ব্যক্তিকে। উনি কোনও চিকিৎসাকর্মী বা ওষুধ সরবরাহ সংস্থার কর্মী নন। শুধুমাত্র মানবতার খাতিরেই তিনি এ কাজ করেছেন। যদিও এর জন্য কুর্নিশ নিতে রাজি নন তিনি। শুধু বলছেন, মানুষই মানুষের জন্য। বিপদে মানুষের পাশে মানুষ ছাড়া আর কে দাঁড়াবে বলুন! কেবলমাত্র ইনজেকশন পৌঁছে দেওয়াই নয়, তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সরকারকে প্রচুর পরিমাণে পিপিই কিট, মাস্ক, গ্লাভস এবং ১০০ লিটার স্যানিটাইজার বিনামূল্যে সরবরাহ করেছেন।
সোদপুরের একজন প্রসিদ্ধ মিষ্টি ব্যবসায়ী কমলবাবু। মিষ্টির দোকানের পাশাপাশি নির্মাণকাজের ব্যবসা রয়েছে তাঁর। অপরদিকে, জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন পান্ডাপাড়া চেকপোস্ট এলাকার বাসিন্দা শুভ্রজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে আরথ্রাইটিসে ভুগছেন। চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে কলকাতার এক চিকিৎসকের অধীনে রয়েছেন। কলকাতার সেই চিকিৎসকের পরামর্শে দু-তিন বছরে একবার ইনজেকশন নিতে হয় শুভ্রজিৎবাবুকে। গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে তাঁর শরীরে যন্ত্রণা শুরু হয়। কলকাতায় গিয়ে ইনজেকশন নেওয়ার ভাবনাচিন্তাও করছিলেন তিনি। কিন্তু এরমধ্যেই লকডাউন শুরু হয়ে যায় দেশজুড়ে। যে কারণে কলকাতা যাওয়া স্থগিত করতে হয়। এদিকে যত দিন যায় যন্ত্রণা ততই বাড়তে থাকে। শারীরিক সমস্যার বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করেন জলপাইগুড়ির চিকিৎসক সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়ে সঙ্গে। সুমন্ত্রবাবুও তাঁকে কলকাতার চিকিৎসকের দেওয়া ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু সমস্যা হল এই ইনজেকশনটি জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গের কোথাও পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতিতে তিনি কলকাতায় লোক পাঠিয়ে ইনজেকশন আনানোর চেষ্টাও করেন।
শুভ্রজিৎবাবুর পরিচিত মৃণালকান্তি মজুমদারের থেকে এই সমস্যার কথা জানতে পারেন সোদপুরের বাসিন্দা কমল দাস। এরপর কিছু না ভেবে নিজেই জলপাইগুড়িতে এসে ইনজেকশন পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন। কলকাতা থেকে ইনজেকশন জোগাড় করে সোদপুর থানার অনুমতি নিয়ে শুক্রবার বেলা ১১টা নাগাদ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। ১০ ঘণ্টায় ৬০০ কিলোমিটার রাস্তা গাড়ি চালিয়ে রাত নয়টায় জলপাইগুড়িতে শুভ্রজিৎবাবুর বাড়িতে পৌঁছান। শনিবার ইনজেকশন নিতে জলপাইগুড়ির রাজবাড়িপাড়ার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি হন শুভ্রজিৎবাবু। রবিবার সকালে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। অপরদিকে রবিবার সকালেই ফের সোদপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান কমলবাবু। তিনি জানালেন, এই একটি ইনজেকশনের দাম ৮৩ হাজার টাকা। ছাড় দেওয়ার পর তার দাম পড়ে ৬২ হাজার টাকা। শুভ্রজিৎবাবু বলেন, কমলদা আমার জন্য কী করেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ওনার মতো মানুষ হয় না।