আসানসোল: মাঝখানে প্রায় সাড়ে তিন দশক। ১৯৮৯ সালের ১৩ নভেম্বর। ঐ দিন পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের রানিগঞ্জে ইসিএলের ভূগর্ভস্থ মহাবীর কোলিয়ারিতে আচমকা দামোদর নদীর জল ঢুকে পড়ে। সেই সময় ঐ কয়লাখনির ভেতর ২৩২ জন কর্মী কাজ করছিলেন। জলমগ্ন খনির ঐ ভেতর থেকে কোনক্রমে নিজেদের প্রাণ নিয়ে ১৬১ জন কর্মী উপরে উঠে আসেন। জলমগ্ন ঐ খনি গর্ভে থেকে যান ৭১ জন কর্মী। সেই ৭১ জনকে উদ্ধারের জন্য ইসিএলের মাইনস রেসকিউ স্টেশন নানান পদ্ধতি শুরু করলেও, ক্রমশ সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। আর এমন অবস্থায় তখন ইসিএলের অ্যাডিশনাল চিফ মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার যশবন্ত সিং গিল নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেন খনি গর্ভে আটকে থাকা কর্মীদের উদ্ধারের জন্য। তারই মাথা থেকে বেরিয়ে আসে এক বিশেষ ধরনের ক্যাপসুল। ইস্পাত দিয়ে তা তৈরি করা হয় তার টিমের মাধ্যমে ইসিএলের সোদপুর ওয়ার্কশপে। সেই ক্যাপসুল জলমগ্ন খনির ভেতরে নামিয়ে তিনি তিন দিনের মাথায় প্রথম উদ্ধার করেন একজন অসুস্থ কর্মীকে। তারপর ১৬ নভেম্বর আরো ৬৪ জন অর্থাৎ মোট ৬৫ জনকে উদ্ধার করে আনেন সেই ক্যাপসুল দিয়ে। ৬ জন মারা গেছিলেন এই দুর্ঘটনায়।
ভারতবর্ষের কয়লা খনির ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় খনি দুর্ঘটনা। এমন একটা ঘটনায় তিনদিন পরে জীবন্ত অবস্থায় ৬৫ জন সহকর্মীকে নিজের তৈরি ক্যাপসুল তৈরি করে উদ্ধার করার জন্যই পরবর্তীকালে তার নাম “ক্যাপসুল গিল” হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯৯১ সালের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কটরমন যশবন্ত সিং গিলকে সর্বোত্তম জীবন রক্ষা পদক পুরস্কারে সম্মানিত করেন। পাঞ্জাবের অমৃতসরে ১৯৩৯ সালে ২২ নভেম্বর যশোবন্ত সিং গিল জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিজের জন্মভূমিতেই মারা যান তিনি। সেই যশবন্ত সিং গিলকে সামনে রেখে টিনু সুরেশ দেশাই ‘মিশন রানিগঞ্জ’ নামে একটি সিনেমা করছেন। ঐ সিনেমার পোস্টার চারদিন আগেই রিলিজ করা হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর আগেই আগামী ৬ অক্টোবর এই সিনেমাটি মুক্তি পেতে চলেছে। যশবন্ত সিং গিলের চরিত্রে অভিনয় করছেন অক্ষয় কুমার। রয়েছেন পরিণীতি চোপড়াও।
এই সিনেমার শুটিং হয় রানিগঞ্জের নিমচা সহ বিভিন্ন কোলিয়ারি এলাকা, আসানসোল স্টেশনে। রানিগঞ্জে সেই হাসপাতাল যেখানে দুর্ঘটনার পর উদ্ধার হওয়া কর্মীদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানেও শুটিং করা হয়েছে। ছবির একটি বড় অংশের শুটিং হয় লন্ডনের ইয়র্কশায়ারে। যদিও শুটিংয়ের একবারে প্রথম দিকে এই সিনেমার নাম ‘ক্যাপসুল গিল’ রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে নাম বদলে যে পোস্টার সামনে এসেছে তাতে দেখা যায় ‘মিশন রানিগঞ্জ’ করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ২৫০ বছরের রানিগঞ্জের কয়লা খনির ইতিহাসে কর্মীদের দুর্ঘটনার সময় মৃত্যুর হাত থেকে কিভাবে উদ্ধার করা হয়েছিলো, তা এই প্রথম সেলুলয়েডে আসতে চলেছে। আর সেই কারণেই আসানসোল-রানিগঞ্জ-দুর্গাপুর খনি শিল্পাঞ্চলের খনি কর্মী, পড়ুয়া থেকে সাধারণ মানুষ সবাই উদগ্রীব হয়ে আছেন তা দেখার জন্য। রূপনারায়নপুরের বাসিন্দা এবং খনি এলাকার পরিবারের সাথে যুক্ত অস্মিত রায় বর্মন বর্তমানে ইসরোতে পড়াশোনার সঙ্গে গবেষণার কাজে যুক্ত আছেন। অস্মিত বলেন, ‘যখন থেকেই এই সিনেমার শুটিংয়ের খবর পেয়েছি তবে থেকেই অপেক্ষা করছি প্রথম দিন ছবি রিলিজ হলেও আমি যেখানেই থাকি না কেন, তা দেখব।’ দীর্ঘদিনের কয়লা খনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সিটু নেতা সুজিত ভট্টাচার্য বলেন, ‘ যখন এই ঘটনা ঘটেছিলো তখন ঐসব কর্মী ও তাদের পরিবারের পাশেই দাঁড়িয়ে আমরা দেখেছি কিভাবে এই ক্যাপসুল দিয়ে উদ্ধার কাজ হয়। ভারতবর্ষের কয়লা খনি দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় উদ্ধার কাজ ছিলো এটা। তাই ছবিটি দেখবার জন্য অবশ্যই মুখিয়ে আছি।’