প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: আদালতের নির্দেশে শনিবার দিল্লির তিহার জেলেই বাবা-মেয়ের আবেগঘন সাক্ষাৎ সম্পন্ন হয়েছে। জেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, মেয়ে সুকন্যা কেন দিল্লি এলেন? কীভাবে এলেন? কার কথায় এই সিদ্ধান্ত তা বার বার জানতে চেয়েছেন ‘কেষ্ট’। বলার অপেক্ষা রাখে না, মেয়ের গ্রেপ্তারি এবং জেলযাত্রা নিয়ে যথেষ্টই উদ্বিগ্ন বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী তৃণমূল নেতা এবং গোরু পাচার কাণ্ডের ‘কিনপিং’ অনুব্রত। সোমবার, রাউজ অ্যাভিনিউ কোর্টে হাজিরার দিনেও সেই উদ্বেগ ধরা পড়ল অনুব্রত মণ্ডলের কণ্ঠে। আদালত চত্বরেই সুকন্যার আইনজীবী অমিত কুমারের হাত ধরে কাতর কণ্ঠে অনুব্রত বলেন, ‘প্লিজ হেল্প! যা হয় কিছু একটা করুন। আমার মেয়েকে বাঁচান।’
কিছুদিন আগেই গোরু পাচার কাণ্ডে চার্জশিট পেশ করেছে ইডি। গোরু পাচার কাণ্ডে দুর্নীতির অভিযোগে যুক্ত থাকায় ইডির চার্জশিটে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে অনুব্রত, সুকন্যা, মনীশ, সেহগল, এনামুল সহ আরও একাধিক জানা-অজানা ব্যক্তির নাম। সোমবার সকালে রাউজ অ্যাভিনিউ আদালতে গোরু পাচার মামলার শুনানিতে প্রধান অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডল সহ সশরীরে উপস্থিত হন সেহগল হোসেন, এনামুল হক, সতীশ কুমার প্রমুখ। ভিডিও বার্তায় সিবিআইয়ের বিচারক রঘুবীর সিংয়ের এজলাসে উপস্থিত ছিলেন আরেক অভিযুক্ত বিকাশ মিশ্রও। এদিন সকাল ১১টা ২০ মিনিট নাগাদ হুইল চেয়ারে বসে, গায়ে হলুদ স্ট্রাইপড টি-শার্ট পরে আদালত কক্ষে প্রবেশ করেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দেহরক্ষী সেহগল হোসেনকে অনুব্রত সেই চেনা মেজাজে বলেন, ‘এই আমার আইজীবীকে ডাক! কোথায় তিনি দেখ জলদি।’
সেহগল হোসেনের ইশারায় সঙ্গে সঙ্গেই অনুব্রতর কাছে আসেন আইনজীবী সম্পৃক্তা ঘোষাল৷ তাঁকে অনুব্রত প্রশ্ন করেন, তিনি অসুস্থ। তবু কেন তাঁকে ভিসির (ভিডিও কনফারেন্স) মাধ্যমে হাজির করা হচ্ছে না? কেন এভাবে বারবার হুইল চেয়ারে বসিয়ে আদালতে নিয়ে আসা হচ্ছে? এটা তো হেনস্তারই শামিল৷ অনুব্রতকে আশ্বস্ত করেন আইনজীবী, আদালতে তাঁরা আবেদন জানিয়েছেন, আদালত নিশ্চয়ই অনুমতি দেবে, বলেন সম্পৃক্তা ঘোষাল৷ এরপরেই অনুব্রত বলেন, ‘সুকন্যার আইনজীবীকে ডেকে দিতে৷’ আদালত কক্ষের অপর প্রান্তে চেয়ারে বসে থাকা সুকন্যা মণ্ডলের আইনজীবী অমিত কুমারকে ডাকেন সম্পৃক্তা ঘোষাল৷ অমিত কুমার কাছে আসা মাত্রই অনুব্রত কাতর কণ্ঠে তাঁকে বলেন, ‘মেয়েকে বাঁচানোর জন্য যা করার করুন৷ কোনও কিছুর কথা ভাববেন না। চিন্তা করবেন না৷ যেটা প্রয়োজন সেটা করুন।’ আইনজীবী অমিত কুমার মাথা নিচু করে সম্মতি জানালও অনুব্রত তাঁর দু-হাত ধরে আর্জি জানান, ‘প্লিজ হেল্প!’ এরপরেই অনুব্রত তাঁর আইনজীবী সম্পৃক্তা ঘোষালকে বলেন, ‘চার্জশিটটা ভালো করে পড়ুন৷’ সম্পৃক্তা জানান, তাঁরা চার্জশিট খুঁটিয়ে দেখেছেন, বেশ কয়েকটি সংস্থার লেনদেনের কথা উল্লেখ করেছে ইডি৷ এই কথা শুনে অনুব্রতর মন্তব্য, ‘যা ইচ্ছে উল্লেখ করুক ইডি৷ চার্জশিটটা ভালো করে পড়ে কড়া ডিফেন্স তৈরি করুন।’
এদিন শুনানি পর্বে, রাউজ অ্যাভিনিউ আদালতের বিশেষ সিবিআই বিচারক রঘুবীর সিং ইডির থেকে জানতে চান, ‘আর লোকজন গ্রেপ্তার হবে? গোরু পাচার কাণ্ডের তদন্ত কী শেষ? প্রশ্নের উত্তরে ইডির আইনজীবী নীতেশ রাণা জানান, ‘এখনও এই মামলা শেষ হয়নি। ইডি গোরু পাচার কাণ্ডের তদন্ত চালাচ্ছে জোর কদমে৷ আরও চার্জশিট জমা পড়ার সম্ভাবনা, এমনকি এই মামলায় আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে শীঘ্রই, দাবি করেন ইডির আইনজীবী। এর পরেই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে চার্জশিটের প্রতিলিপি দেওয়ার জন্য ইডিকে নির্দেশ দেন বিচারক রঘুবীর সিং৷ সমস্ত অভিযুক্তর আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার পরে বিচারক রঘুবীর সিং জানান, ১২ জুলাই এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে৷ ততদিন পর্যন্ত তিহারেই থাকতে হবে গোরু পাচার কাণ্ডের অভিযুক্তদের৷
শুনানি শেষে হুইল চেয়ারে আদালত কক্ষ ছাড়ার সময়ে অনুব্রতকে প্রশ্ন করা হয় তাঁর মেয়ে সুকন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে৷ শনিবার তিহারে দেখা হয়েছিল আপাতত জেল বন্দি বাবা-মেয়ের৷ সেই প্রসঙ্গে অনুব্রত বলেন, ‘বাবা মেয়ের সঙ্গে যা কথা হওয়ার হয়েছে৷ মেয়ের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হল৷ আধঘণ্টা কথা হয়েছে।’ এদিকে, আগামী ১২ মে দিল্লির রাউজ অ্যাভিনিউ কোর্টে সুকন্যা মণ্ডলের জামিনের আবেদনের শুনানি৷ এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে অনুব্রতর জবাব, ‘ঈশ্বর করুন, মেয়েটা যেন জামিন পেয়ে যায়৷’ নিজের শরীর খারাপ, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বেড়েছে, আগের তুলনায় শরীর আরও বেশি খারাপ হয়েছে তিহারে থাকাকালীন, রাউজ এভিনিউ আদালতে অপেক্ষামান সংবাদ মাধ্যমের সামনে সোমবার দাবি করেছেন অনুব্রত মন্ডল৷ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে নীরব থাকেন অনুব্রত।