রণবীর দেব অধিকারী, ইটাহারঃ বাবা, দেখো আমি একটা এরোপ্লেন বানিয়েছি। এখন নয় মা, সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখব। তড়িঘড়ি মেয়েকে টা টা করে বেরিয়ে পড়েন ডাঃ সুজয় সরকার। হাওয়ায় ছুড়ে দেওয়া কাগজের এরোপ্লেন গোত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ঘরের কোণে। ফ্যানের হাওয়ায় মেঝেতেই লুটোপুটি খায় ছোট্ট মেয়ের আবদার।
সুজয়বাবু ইটাহার ব্লকের সেকেন্ড মেডিকেল অফিসার। করোনা সংকট মোকাবিলায় রাতদিন ব্যস্ত। মেয়েকে সময় দেওয়া তো দূরের কথা, কোনও কোনও দিন দুপুরের খাবারটাও সময়মতো খাওয়ার জো হয় না। অবশ্য একা সুজয়বাবু নন, ব্লক স্বাস্থ্য দপ্তরের সব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই দিনরাত এক করে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কাজ করে চলেছেন। তবে তারই মধ্যে ডাঃ সুজয় সরকারের একটু বাড়তি চাপ রয়েছে। যেমন, হাসপাতালের ফ্লু ক্লিনিক থেকে শুরু করে তিন-তিনটি কোয়ারান্টিন সেন্টারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। প্রতিদিন ফ্লু ক্লিনিকে আসা রোগীদের কাকে পাঠানো হবে হোম কোয়ারান্টিনে, কাকে সরকারি ব্যবস্থার কোয়ারান্টিনে, তা ঠিক করে দেওয়ার বিষয়টি সামলাতে হচ্ছে তাঁকেই। এরই ফাঁকে দুইবার প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের কোয়ারান্টিন সেন্টারে থাকা মানুষদের ভিজিট করে তাঁদের খাওয়াদাওয়া সহ শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়ে সবরকম বন্দোবস্ত করার দায়িত্বই তাঁর। দিনভর এসব দায়িত্ব সামলে সমস্ত কিছুর রিপোর্ট তৈরি করে তা আবার পাঠাতে হচ্ছে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে। জরুরি ভিত্তিতে পুরো প্রক্রিয়াটাই সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পরিচালনা করছেন সুজয়বাবু।
স্বাস্থ্য দপ্তর, পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনের তৎপরতায় ইটাহার ব্লক, এমনকি গোটা উত্তর দিনাজপুর জেলাই এখনও পর্যন্ত করোনা থেকে দূরে রয়েছে। অর্থাৎ করোনা সংক্রমণের বিচারে উত্তর দিনাজপুর রয়েছে সেফ বা গ্রিন জোনে। চাপা আতঙ্কের বাতাবরণ থাকলেও সাধারণ নাগরিকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন সুজয়বাবুদের মতো ইটাহারের সমস্ত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও প্রশাসনের নিরলস প্রচেষ্টার সৌজন্যেই।
সুজয়বাবু নিজেও একা কৃতিত্ব নিতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, তিনি একা নন, পুরোটাই টিম ওয়ার্ক। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের গাইডলাইন মেনে সবরকম ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে ভালো রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সুজয়বাবুরা।
দিনের শেষে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে সমস্ত রিপোর্ট পাঠিয়ে আবার কখন ইমার্জেন্সি কল আসবে ভাবতে ভাবতে সুজয়বাবু যখন ঘরে ফেরেন, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। পাঁচ বছরের ছোট্ট কৌশিকী তখনও একা একা খেলছে পাশের ঘরে। ইচ্ছে হয়, ওঘরে গিয়ে মেয়েকে একটু আদর করার। ইচ্ছে হয়, মেয়ের সঙ্গে একটু খেলা করার। এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসেন সুজয়। এখনও এ জেলায় পজিটিভ কোনও কেস পাওয়া যায়নি। তাতে কী? সাবধানের তো মার নেই! এই কটা দিন মেয়ের সঙ্গে দূরত্বটাই থাক! সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স…