মহুয়া চট্টোপাধ্যায়, শিলিগুড়ি: “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর…”
নারী= মা
নারী= ভগিনী
নারী= জায়া
নারী= দুহিতা
নারী= মানুষ?
কি জানি? মানুষ নাকি যন্ত্র নাকি পশুর মতো পড়ে পড়ে মার খাওয়া একটা জাতি?!
এইটুকু পড়েই রে রে করে উঠবেন না যেন, মেয়েরা চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহ পাড়ি দিচ্ছে, রিসার্চ করছে , শিক্ষিকা হোক বা ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি কিংবা পাইলট, দৌড়বিদ বা সাঁতারু, স্কলার বা ডক্টরেট, গোয়েন্দা বা গিন্নী; সর্বরূপেই তাঁরা সংস্থিতা, দৃশ্যতঃ তার বাকি ৮টা হাত অদৃশ্য কিন্তু মাল্টিটাস্কিং – এর বহর দেখলে তা আর মনে হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি বলে নিজের এবং অন্যের মাথা খারাপ করার আগে একটু থামুন – ভাবুন আর নিজেকে প্রশ্ন করুন কি দিলেন আর কি পেলেন? কি হতে পারতেন কি হয়েছেন? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যা যা দিয়েছেন তার কত শতাংশ নিজের জন্য ব্যয় করেছেন? যদি সবকটির উত্তরে আপনি সন্তুষ্ট হন তাহলে আপনি ভাগ্যবতী আর যদি উত্তর অসন্তোষমূলক হয় তাহলে আমার গল্প, কথা, আর প্রতিবেদন আপনার জন্য।
বড় কথা, বিরাট স্কিম, টাকা জমানো, বিয়ের বয়স বাড়ানো (১৬.১২.২০২১ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় প্রস্তাব পাস), পণের দাবিদারদের জেলে পাঠানো, ইভটিজারদের শাস্তি, ধর্ষণকারীকে ফাঁসি, অ্যাসিড আক্রান্তকে পুনর্বাসন আরও কত কি সমাজ করেছে নারীদের জন্য কিন্তু কখনও তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, লড়াই করার, বিপদে মুখোমুখি হবার জন্যে সাহস যোগায়নি, বরং পেছনে টেনেছে, পিছুটান দিয়েছে , আত্মবিশ্বাস যাতে টলে যায় সেই সব কাজ করেছে আর বুঝিয়েছে সমাজে একা থাকা বা লড়াই করা নারীদের সমাজ বহুভোগ্যা মনে করে, বিপদ তাদের পদে পদে কারণ নারীদেহ প্রলুব্ধ করে পুরুষদের এবং এই সংক্রান্ত উদাহরণ ও পেশ করা হয় রংচং সমেত। কেউ কেউ এই সব শুনে পিছিয়ে যান নিজেকে স্বাবলম্বী করার ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়ে কাউকে আবার জোর করে সংসারের যাঁতাকলে যুতে দেওয়া হয় আমৃত্যু, কিন্তু জীবনের বাজিটা জিতে যান তাঁরা যারা এসবে পাত্তা না দিয়ে লড়ে যান নিজের স্বপ্নের পথে। নারীদের এই উত্তরণ বা অবতরণে যারা দায়িত্ব নিয়ে থাকেন তাঁরা বেশীরভাগ পুরুষ অল্পভাগ নারী। আবহমান কাল ধরে নারীদের বোঝানো হয়েছে এবং হচ্ছে তাঁরা পুরুষ ছাড়া অসহায় লতার মতো ছিন্নমূল এবং উদ্বাস্তু, মা হবার সুখ কেবল পুরুষ করতলগত , আর্থিক-সামাজিক-মানসিক নিরাপত্তা দেবে শুধু পুরুষ বাবা-ভাই-স্বামী-ছেলে হয়ে, মহিলারা তাদের আদেশপালন করবে মাত্র। সব ভালো খাবার, পোশাক, আরাম শুধুই তাদের জন্য, বেশি দূর যাবার দরকার নেই উদাহরণের জন্য নিজের আশেপাশে নজর চালালেই পরিষ্কার হবে দৃশ্য। নতুন বৌয়ের সিঁদুর-শাঁখা-আলতা-ঘোমটা জরুরি কি না নজর লাগবে, সাতসকালে উঠতে হবে নইলে স্বামীর শরীর খারাপ হবে, পিরিয়ড হলে বিছানায় শোওয়া যাবে না তাতে স্বামীর আয়ু কমবে, জোরে হাসা যাবে না, কান্না অলক্ষ্মীর লক্ষণ, সন্ধ্যেবেলা চুল খুললে ডাইনি, দুপুরে ঘুমোয় মোষেরা, চাকরীতে শাড়ি বা চুড়িদার জিন্স পরা যাবে না, অফিস টার্গেট আবার কি? বিকেলের মধ্যে বাড়িতে আসা চাই, রাতের রান্না কে করবে? ধেই ধেই করে না নেচে বাচ্চার কথা ভাবো, আর কতদিন বছর তো ঘুরে গেল; এইসব চূড়ান্ত ভালোভালো কথা অহরহ মহিলাদের কানের কাছে গুণগুণ করে বোলতা-সমাজ। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে সে একটা কথা বললেই ডিভোর্স, আর ডিভোর্সীদের সমাজে স্থান নরকতুল্য। তবে এতো না-বাচকের মাঝেও মেয়েরা বাঁচে, বাঁচায় সংসার-সন্তানকে, দশভূজার মতো আগলায় সবকিছু, তবুও দিনশেষে পড়ে থাকে অবজ্ঞা আর বাঁকা কথা, সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির প্রাপ্য চোখের জলে ভাত ভিজিয়ে গেলা। এখানে মনে করিয়ে দিই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় যার সে কিন্তু ঘুরে মারে, এবার মহিলাদের সেই ঘুরে মারার দিন। ক্রিকেট বা ফুটবল, রান্না বা মেকআপ, ডাক্তার বা ফুল বিক্রেতা; মহিলারা এগিয়ে যাচ্ছেন, স্পেসশিপ থেকে দেখছেন পৃথিবীকে, ঈশ্বরের বাসস্থানের কাছে গিয়েও স্বামী-সন্তানের মঙ্গল চাইছেন, দুঃখের কথা নারীকে আজও কেউ চিনলনা, জানল না তার বেদনার কথা, মূল্যায়ণ হল না তার ত্যাগের, দেহ ভাবনার মাঝে আটকে গেল আত্মার আত্মীয়তা।
আরও পড়ুন : বিদেশি ডিগ্রিতে হাফ ডাক্তার, তবু এমন পরম্পরা দেশে চলবেই