রণজিৎ ঘোষ, নকশালবাড়ি : লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। সজলধারা প্রকল্পের আওতায় নকশালবাড়ি ও খড়িবাড়ি ব্লকের প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতে জলাধার নির্মাণও হয়েছিল। কিন্তু এলাকাবাসীর পানের জন্য এখনও ভরসা শুধু কুয়োর জল। তাও যেন ভাগ্যে নেই গ্রামবাসীর। বেআইনি দখলদারি ও চরে বেপরোয়া বালি-পাথর উত্তোলনে শুকিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পাশের নদী। ফলে গ্রামে ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে গিয়েছে। এতে শুকিয়ে কাঠ কুয়োগুলি। তেষ্টা মেটানোর জল পাওয়াই দুষ্কর এই দুই ব্লকে। নদী থেকে জল তুলে গ্রামের চায়ের আবাদে সেচ চলে। এতে আরও কমে যায় নদীর জল।
প্রশাসনের নজর এড়িয়ে নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি-পাথর পাচারের পাশাপাশি অবৈধ নির্মাণের কারণে অনেক জায়গায় নদীর গতিপথ বদলে গিয়েছে। বর্ষার সময় কুয়োয় যাও বা সামান্য জল থাকে, কিন্তু গরম পড়লে দুর্ভোগের শেষ থাকে না গ্রামবাসীর। তখন জলের খোঁজে দুই কিমি পর্যন্ত হাঁটতে হয়। অনেক দূরে নদীর বুক চিরে জল নিয়ে আসেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রায় দশ-বারো বছর আগে এই দুই ব্লকের সব গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জলাধার নির্মাণ করেছিল জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দপ্তর। গ্রামে জল সরবরাহ করার জন্য মাটি খুঁড়ে বসানো হয় পাইপ। তৈরি হয় ট্যাপকলও। পাম্পহাউস তৈরি করে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদকে। কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দেড় বছরের মাথায় অকেজো হতে শুরু করে পাম্পগুলি। ফলে গ্রামে পানীয় জলের সরবরাহ ব্যাহত হয়।
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি তাপস সরকারের অবশ্য বক্তব্য, সজলধারা প্রকল্পটি কেন্দ্রীয় সরকারের। কেন্দ্র প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়ায় আর আর্থিক বরাদ্দ আসেনি। আমরা চা বাগান মালিকদের এই প্রকল্পের দায়িত্ব নিতে বলেছিলাম। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তবে পূর্ত দপ্তরের তরফে পানীয় জলের আলাদা প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। সেগুলি চালু হয়ে গেলেই সমস্যা মিটবে। কিন্তু ততদিন কি এরকমই জলকষ্ট থাকবে? এই প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে নকশালবাড়ি ব্লকের হাতিঘিসা, মণিরাম এবং খড়িবাড়ি ব্লকের বুড়াগঞ্জ, বিন্নাবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়।
পানীয় জলের সমস্যা এখন ভয়াবহ আকার নিয়েছে। নকশালবাড়ি ব্লকের একেবারে পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মহিষমারি নদী। কিন্তু যথেচ্ছ বালি-পাথর উত্তোলনের ফলে নদীতে আর আগের মতো জল নেই। ফেব্রুয়ারি থেকে সংকট শুরু হয়। এপ্রিল-মে মাসে নদীর জলস্তর একেবারে নেমে গেলে আর জলই মেলে না। এর প্রভাব পড়ে পাশের গ্রামগুলিতে। কুয়ো এবং নলকূপের জল শুকিয়ে যায়। গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে এলাকায় একাধিক গভীর নলকূপ বসানো হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেগুলির বেশিরভাগই এখন অকেজো। যে কটি টিকে আছে, দুর্গন্ধ আর আয়রনের জন্য সেই জল মুখে তোলা যায় না। বাধ্য হয়ে গাঁটের কড়ি খরচ করে জল কিনে খেতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের।
নকশালবাড়ির বীরসিংজোতের বাসিন্দা নন্দ সিংহের কথায়, সামান্য জলের জন্য গরমকালে ছটফট করতে হয়। বাধ্য হয়ে অনেক দূরে গিয়ে নদী থেকে জল এনে খেতে হয় তখন। পরিস্রুত না হওয়ায় মাঝে মাঝে ওই জল খেয়ে পেটের অসুখ হয়। একই সমস্যার কথা জানালেন ওই ব্লকের জমিদারগুড়ির বাসিন্দা লবন্ত সিংহ।
খড়িবাড়ি ব্লকের অবস্থা ভিন্ন কিছু নয়। এই ব্লকে দুই নদী-মেচি এবং চেংগা। দুই নদীতেই দুষ্কৃতী দাপট এখন চরমে। অনেক জায়গায় নদীর গতিপথ আটকে গজিয়ে উঠেছে অবৈধ নির্মাণ। ফলে নদীতে গরমের শুরুতেই জল নেই বললেই চলে। বুড়াগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের শ্যামল বাইনের বক্তব্য, অপরিকল্পিতভাবে বালি তুলে এবং গতিপথ পরিবর্তন করে দেওয়ায় চেংগা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। যার জেরে আশপাশের কোনও গ্রামে মাটির তলায় আর জল থাকছে না। বাধ্য হয়ে পুকুরের জলে কাজ সারতে হচ্ছে। খাওয়া থেকে শুরু করে স্নান, কাপড় কাচা সবই চলছে পুকুরের জলে। একই কথা জানালেন এলাকার আরেক বাসিন্দা মৌসুমি হাঁসদা। তাঁর আশঙ্কা, দ্রুত পানীয় জলের সমস্যার প্রতিকার না হলে এই গ্রীষ্মে দুর্ভোগ চরমে উঠবে।