তমালিকা দে, শিলিগুড়ি : অশক্ত শরীর। কিন্তু জীবনসংগ্রামে হার না মানার জেদ। লড়াইটা সিঁথির সিঁদুর রক্ষার। স্বামীকে সুস্থ করে তোলার জেদে প্রতিদিন সাইকেল রিকশার প্যাডেলে পা রাখেন ফুলমণি মণ্ডল। বয়স ৬০-এর কোঠায়। কিন্তু মানসিকতায় যে কোনও শক্তপোক্ত যুবককে পিছনে ফেলে দিতে পারবেন ফুলমণি। পারবেন না কেন? ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত স্বামী গণেশ মণ্ডলকে বাঁচিয়ে রাখার কথা মনে পড়লেই যে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে মালদার ফুলমণির। বয়স ভুলে সওয়ারি নিয়ে সাইকেল রিকশার প্যাডেলে চাপ দেন তিনি। সকাল-সন্ধ্যা তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় শিলিগুড়ি সংলগ্ন ফুলবাড়ির সিআরপিএফ ক্যাম্প এলাকায়। তিন চাকার সাইকেল রিকশা তাঁর সঙ্গী। সওয়ারি ডাকলেই দুটো রোজগারের আশায় খুশির ঝিলিক খেলে যায় ফুলমণির চোখে।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল ফুলমণির। মালদা থেকে নতুন বৌ স্বামীর হাত ধরে চলে এসেছিলেন শিলিগুড়িতে। বর্তমানে তাঁরা কাওয়াখালির বাসিন্দা। বিয়ের পর থেকে ঘর সামলাতেই সময় কেটে গিয়েছে তাঁর। দুই ছেলে ও এক মেয়েছে বড় করতেই দিন কেটে গিয়েছে। দশ বছর আগে মাথাব্যথা নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে দেখাতে যান গণেশবাবু। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান ব্রেন টিউমার হয়েছে। কলকাতায় চিকিৎসা করাতে হবে। হতদরিদ্র রিকশাওয়ালা গণেশবাবুর পক্ষে তা আর সম্ভব ছিল না। তখন থেকেই রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে য়ায়। দুই ছেলে, এক মেয়ে এবং অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে ফুলমণি চোখে অন্ধকার দেখেন। একসময় অভাব এতটাই চরম আকার নেয় য়ে স্বামীর চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে যায়।
ছেলেমেয়ের মুখে দুটো ভাত জোগাতে আর স্বামীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে অনেকের কাছে ফুলমণি হাত পেতেছিলেন। কিন্তু কোথাও সেভাবে সাহায্য পাননি। একসময় বাড়িতে পড়ে থাকা স্বামীর রিকশায় হাত রাখেন তিনি। শাড়ি পরে কখনও টেনে, আবার কখনও হাফ প্যাডেল করে সওয়ারি নিয়ে ছুটে চলার শুরু সেই থেকেই। ফুলবাড়ির বিভিন্ন রাস্তায় ফুলমণিকে আস্তে আস্তে চিনে গিয়েছেন এলাকার মানুষ। তাঁর লড়াইকে সেলাম জানিয়ে অনেক সওয়ারি বাড়তি ভাড়াও দেন। পাশে দাঁড়ানো এই সওয়ারিরা ফুলমণির মনের জোর বাড়িয়ে দেয়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা অগ্রাহ্য করে সপ্তাহে সাতদিনই তিনি রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সওয়ারির খোঁজে।
ফুলমণি বলেন, স্বামীকে সুস্থ করে তুলতেই আমার লড়াই। বড় ছেলে দিনমজুরের কাজ করে। নিজের সংসার টানতেই হিমসিম খেতে হয়। ছোট ছেলে একবছর আগে মারা গিয়েছে। রিকশা টেনেই মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে স্বামী কলকাতায় চিকিৎসাধীন। তাঁর চিকিৎসার খরচ জোগাতেই রিকশা টেনে চলি।