শুভঙ্কর ঘোষ
ইউক্রেনে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের দুর্দশা দেখে সবারই মন খুব চঞ্চল। ভাবী ডাক্তারদের অনেকে বাংকারে রাত কাটাচ্ছেন, কেউ হেঁটে যাচ্ছেন পোল্যান্ড বা রোমানিয়ার সীমান্তের দিকে, কেউ ইউক্রেন পুলিশের হাতে মার খাচ্ছেন- সব দৃশ্য দেখে আমাদের সবাই আলোড়িত। পাশাপাশি নানা প্রশ্ন, নানা বিতর্ক। অধ্যাপক হিসেবে অনেক কথা ভাবাচ্ছে।
এমনিতে ঘটনাগুলি নতুন কিংবা বিচ্ছিন্ন নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়াদের পাখির চোখ নির্দিষ্ট থাকে বিভিন্ন পেশায় প্রবেশিকা পরীক্ষার দিকে। আর্থিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সফল পেশা হিসেবে কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ ডাক্তারি, কেউ আইন, না হলে অন্যান্য কিছু সীমিত ক্ষেত্রের প্রবেশিকা উতরে যাওয়ার চেষ্টা করে প্রায় সকলেই। কিন্তু একশো চল্লিশ কোটি মানুষের এই দেশে সাফল্যের লড়াই স্বাভাবিকভাবেই নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসংগত প্রাসঙ্গিকতা ডেকে আনে। এই প্রেক্ষিতে আইআইটি প্রবেশিকা জেইই মেন ও আ্যডভান্সড, ডাক্তারির নিট, আইনের ক্লাট প্রভৃতির জন্য টার্গেট প্রস্তুতি কোর্সের রমরমা।
দীর্ঘ লড়াইয়ে পরেও অনেকে ব্যর্থ হয়। সংখ্যাতত্ত্ব বলে, কৃতকার্য হওয়ার তুলনায় অকৃতকার্যের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। ডাক্তারির নিটের ক্ষেত্রে উপরের অসাম্য বড় বেশি প্রকট। স্বাভাবিকভাবে অনেক পড়ুয়া সফল পেশার কোর্সে যেনতেনপ্রকারেণ ঢুকে পড়ে দেশের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে অর্থের জোরে।
এই প্রবণতার আরেকটি দিক হল, ডাক্তারির সফল পেশার রঙিন স্বপ্ন দুচোখে মেখে অনেক ভারতীয় ছাত্রছাত্রী ডাক্তারি পড়তে পাড়ি দেয় প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান থেকে শুরু করে ফিলিপিন্স, চিন, রাশিয়া, ইউক্রেন, কাজাখস্তান প্রভৃতি দূরদেশেও। কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে চলে আসে নিটে অকৃতকার্যতা এবং এইসব দেশে কম খরচে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পাওয়া। এর উপরে অবশ্যই আছে কোর্সের লঘুচাপ এবং উন্নত পরিকাঠামোর সুবিধা। ইউক্রেনের নবীন এই প্রজন্মের এক পড়ুয়াকে, চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থেকে যুদ্ধের কালো দিনেও খাবার আনতে বলি দিতে হল তার তাজা প্রাণ। বিতর্ক এড়িয়ে বলতে পারি, শেষ হয়ে গেল একটি সম্ভাবনা, একটি প্রতিশ্রুতি।
ব্যক্তিগতস্তরে অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি, কখনও কখনও পড়ুয়াদের জেদাজেদি থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের মনোভাব কাজ করে এমন সিদ্ধান্তে। ফলশ্রুতিতে জন্ম নিয়েছে ভারতবর্ষের আরেকটি সমস্যা, বিদেশি ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের অসফল পেশাদারদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা।
এটা অনেকেই জানেন, বিদেশি ডাক্তারি কোর্স শেষে দেশে ফিরে নিটের থেকেও আরও বেশি কঠিন পরীক্ষায় সফল হলে তবে মিলবে পেশায় প্রবেশের অনুমতি। পরীক্ষার নাম এফএমজিই। ২০০২ সালে শুরু করা হয় চিকিৎসা বিদ্যায় বিদেশি ডিগ্রি লব্ধ ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য চিকিৎসক পেশার প্রবেশিকা পরীক্ষা। প্রথম থেকেই ফলাফল খুব হতাশাজনক। ২০০২ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রতি বছরের পরীক্ষায় পাশ করার গড় মাত্র ২৩ শতাংশ। ২০০৫-২০০৬এর প্রবেশিকা পরীক্ষায় ৬৭ শতাংশের সামান্য বেশি কৃতকার্য হওয়ার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিলে ধরে নেওয়া যায়, গড়ে শতকরা মাত্র কুড়িজন ভারতে চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃত হন। গত বছরে পরীক্ষায় বসা পঁচিশ হাজারেরও বেশি বিদেশি ডিগ্রিধারী ভারতীয় ডাক্তারের মধ্যে কুড়ি শতাংশ কৃতকার্য হয়েছেন।
ভারতীয় তরুণ নবীনের ইউক্রেনে মৃত্যুর পরে কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি হিসেব দিয়েছেন, বিদেশে যেসব পড়ুয়া এমবিবিএস পড়তে যান, তাঁদের শতকরা নব্বই ভাগ এ দেশে ডাক্তারি করার যোগ্যতায় ফেল করেছেন। ওই সময়, ওই দিনই কথাটা বলা উচিত কি না প্রশ্ন উঠবে। হতভাগ্য নবীনের বাবাই এ প্রশ্নটা তুলেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতে প্রাইভেটে ডাক্তারি পড়তে ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা না লাগলে তাঁর ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে হত না। ঠিক বলেছেন। তবে বাস্তব এটাই যে, বিদেশ থেকে ডাক্তারি ডিগ্রি এনেও অনেকে শেষপর্যন্ত ডাক্তারি করতে পারছেন না পরের পরীক্ষায় পাশ না করায়।
প্রশ্ন উঠবেই, কেন এই ব্যর্থতা? প্রবেশিকা পরীক্ষায় ব্যর্থ ডিগ্রিধারী এত ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ কী? গত কুড়ি বছরের চিকিৎসা পেশায় ঢুকতে আপাত ব্যর্থ বিপুল সংখ্যক মানুষের পরিণতি কী হয়েছে? স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার হালহকিকত যাঁরা জানেন, স্বীকার করবেন যে গত পঁচাত্তর বছরে উপরে উপরে কিছু পরিবর্তন আনা ছাড়া মৌলিক কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। মেডিকেল শিক্ষাতেও কি তা নয়?
১৯১৬ সালের ভারতীয় মেডিকেল ডিগ্রি আইনের উত্তরাধিকার পায় ১৯৫৬ সালে চালু হওয়া ভারতীয় মেডিকেল কাউন্সিল আইন। অবশেষে ২০১৯ সালে আসে জাতীয় মেডিকেল কমিশন আইন, যা এমসিআই-কে বাতিল করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। এমসিআই হোক বা এনএমসি হোক, এদের ঘিরে বিতর্কের সঙ্গে আবর্তিত হয় দুর্নীতির প্রাসঙ্গিকতা। দুদশক হতে চলল যখন এমসিআই প্রধান কেতন দেশাইকে সুপ্রিম কোর্ট শাস্তি দেয়- শুধু এমসিআই নয়, আইএমএ থেকেও পদত্যাগে বাধ্য করে।
অর্থশাস্ত্রের চাহিদা ও সরবরাহের মূলমন্ত্র মানতে হয় সব পেশাকেই। আমাদের দেশে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ডাক্তারদের সংখ্যা এখনও অপ্রতুল। ভারতের মতো দেশে হাজার রোগী পিছু একজন ডাক্তার নেই। সংখ্যাতত্ত্বের গোলমেলে হিসেবে এখন ১০০০ রোগীর জন্য ০.৭৪ সংখ্যক চিকিৎসক। সেটা গ্রামগঞ্জে আরও খারাপ, কিছু রাজ্যের জন্য ছয় হাজার রোগীর জন্য একজন ডাক্তার। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি আছে যে ডাক্তার রোগীর এই অনুপাত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত সর্বনিম্ন ১:১০০০ হওয়ার লক্ষ্যসাধন হবে ২০২৪ সালে। অথচ উন্নত বিশ্বে আমেরিকা ইংল্যান্ড জার্মানির মতো দেশে এই অনুপাত হাজার জনসংখ্যা বা রোগী পিছু ২.৪ । এমনকি পড়শি চিনেও এটি ১.৭।
একই রকমের চিত্র ভারতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার আনাচে-কানাচে। রোগীর সংখ্যা অনুপাতে নার্সের সংখ্যাও এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। দেশে প্রতি বছর ৬০৫টি মেডিকেল কলেজের থেকে বেরিয়ে আসে প্রায় নব্বই হাজার স্নাতক ডাক্তার। স্বাভাবিকভাবেই প্রথাগত অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের ঘাটতি মেটাতে আয়ুষ এবং অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে জোর দিয়ে আরও পঞ্চাশ হাজারের উপর চিকিৎসক তৈরি করা হচ্ছে।
সুতরাং নবীনদের নিয়ে একটি সুরাহা ভাবা উচিত। তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে ধরে নিয়ে বলা যায়, বছরের পর বছর সময় নষ্ট না করে বিদেশি ডিগ্রিধারীদের অর্জিত জ্ঞান ও কুশলতা সীমিত হলেও সহায়ক বা গবেষণার কাজে ব্যবহারের সুযোগ এগিয়ে দেওয়া। তাতে কোয়াক ডাক্তারদের রমরমা কমবে। হাফ ডাক্তার বললেও যদি আমাদের দেশে রোগীদের লাভ হয়, তরুণদের কর্মসংস্থানের সমস্যা মেটে, তা হলে ক্ষতি কি? ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদের এক সামাজিক সমস্যাকে তুলে ধরল। সরকারের চোখ খুলুক।
(লেখক সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক)