জসিমুদ্দিন আহমেদ, মালদা : মালদা শহরের মিরচকের সোনাঝুরি রোদে প্রাথমিক স্কুলের মাঠে একা বসে সানাইয়ে হারিয়ে যাওয়া সুর খোঁজেন মালদার বিসমিল্লা বলে পরিচিত মহম্মদ ইলিয়াস আলি।
এক সময় তাঁর সানাইয়ে সুরে মুখরিত হত নেপালের রাজ দরবার। তাঁর খ্যাতি তখন বাংলা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও পৌঁছে গিয়েছিল। এখন এই সুরের জাদুকরের দৈন্যদশা। বার্ধক্যে পৌঁছে এখন আর সানাইয়ে সুর তুলতে পারেন না। বেঁচে থাকার সম্বল বলতে এখন রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের দেওয়া সাম্মানিক ভাতা। তাও মেলে ৭ মাস পরপর। এবিএ গণি খান চৌধুরির সুপারিশে বাজপেয়ী সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ভাতা শুরু হয়েছিল। তবে বেশিদিন মেলেনি। ৩ বছর পরই সেই ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। ভাতা পুনরায় চালুর জন্য একাধিক বার দিল্লিতে আবেদন করেছেন। কিন্তু কোনো জবাব মেলেনি। এখন সেই আশা ছেড়ে দিয়েছেন সানাইয়ে জাদুকর।
এখন সময় কাটে পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মদের সঙ্গে। তবে বংশানুক্রমিক সুরের ধারা তাঁর পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে তিনি খুশি।মালদা শহরের মীরচক এলাকায় মহম্মদ ইলিয়াস শেখের বাড়ি। পরিবারে ৫ পুরুষ ধরে সুরের ধারা তাঁদের রক্তে বইছে। এদিন দুপুরে মীরচকে গিয়ে দেখা গেল, ইলিয়াস প্রাথমিক স্কুলের মাঠে একাকী বসে শীতের দুপুরে নীল নিলীমার দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছেন। প্রশ্ন করতেই জানা গেল, সুরগুলো আর কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। জানালেন, এখন আর সানাই বাজাতে পারেন না। বয়স ৭৬ বছর অতিক্রম করেছে। ইলিয়াসবাবু এখন অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে কোনোক্রমে বেঁচে রয়েছেন।
তিনি বলেন, আমার পূর্বপুরুষেরা উত্তরপ্রদেশ থেকে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে আসেন। এক দাদু ইয়াকুব ছিলেন যন্ত্রী। আর এক দাদু দিদারুদ্দিন খান ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী। সেই সূত্রে আমার বাবা লাল মহম্মদও সুরের জগতে আসেন। তিনি মায়ের সঙ্গে জঙ্গিপুর ছেড়ে মালদা শহরের মিরচকে চলে আসেন। তিনি বলেন, বাবা সেসময় পাকিস্তানের পেশাওয়ারের এক সঙ্গীত বিশারদের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। পরে ফিরে আসেন। কিন্তু সেসময় শুধু সানাই বাজিয়ে সংসার চালানোর মত খরচ উঠত না। তাই ব্যান্ডপার্টির দল তৈরি করেন রোজগার বাড়ানোর জন্য। এভাবেই আমি খুব অল্প বয়সেই বাবার কাছ থেকে হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি ও সানাই বাজাতে শিখি।
স্মৃতির সমুদ্র থেকে উঠে এসে বললেন, অল্প বয়সেই আমার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। আমি পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সমস্ত জেলায় সানাই বাজানোর আমন্ত্রণ পেয়েছি। বিহার, ঝাড়খণ্ড এমনকি নেপাল থেকেও আমার ডাক আসতে শুরু করে। নেপালের রাজ দরবারে সানাই বাজিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিলাম। ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে আমাকে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে সম্মানিত করা হয়। একটা শিল্পী পরিচয় কার্ডও বানিয়ে দেন তাঁরা। সরকারি বহু অনুষ্ঠানে সানাই বাজিয়েছি। তবে রোজগার করিনি একথা বলব না। কিন্তু এত বড়ো পরিবার চালাতে সেই রোজগার যথেষ্ট ছিল না বলে কিছু করে উঠতে পারেনি।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে ইলিয়াস বললেন, এখন বয়সের ভারে আর সুর তুলতে পারি না। রাজ্য সরকার একটা ভাতা দেয়, তাও খুবই সামান্য। ৪ হাজার-৫ হাজার টাকা। তাও ৬ মাস বা ৭ মাস অন্তর। সে টাকাতে কিছু হয় না। বরকত গণি খান চৌধুরি ও তপন সিকদার কেন্দ্রীয় অনুদানের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। বাজপেয়ী সরকারের আমলে ৩ বছর, বছরে ২৪ হাজার টাকা করে পেতাম। তারপর হঠাৎই সেই অনুদান বন্ধ হয়ে যায়। এনিয়ে বহু আবেদন নিবেদন করেছি, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এখন কেন্দ্রীয় অনুদানের আশা ছেড়েই দিয়েছি। ইলিয়াস আলি আরও বলেন, সংগীতের সুর আমাদের রক্তে বইছে। আমার ছেলে সানাই বাজায় না। তবে সে ভালো স্যাক্সোফোন বাজায়। তার মেয়ে সাদিয়া খাতুনও স্যাক্সোফোন বাজানোর তালিম নিচ্ছে কলকাতায়। আমি চাই আমার পরবর্তী প্রজন্ম সংগীতের ধারা বয়ে নিয়ে যাক। তাদের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।