জয়দীপ বসু
সম্প্রতি বাংলা ভাষার এক পরিচিত লেখক তাঁর বাল্যকালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানিয়েছেন মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পিতৃব্যর হাত ধরে গড়ের মাঠে দর্শক হিসাবে পা রাখেন। সেই স্মৃতি তাঁর মনে আজও উজ্জ্বল; তারপর থেকেই তিনি কলকাতার ফুটবলের এক প্রগাঢ় প্রেমিক, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের দীর্ঘ রেষারেষির এক উত্সাহী অংশীদার।
এই লেখক চল্লিশ পেরিয়েছেন অনেকদিন, হয়তো আর কয়েক বছর বাদেই তাঁকে প্রবীণদের দলভুক্ত করে ফেলবেন কেউ কেউ। তাতে অবশ্য তাঁর কিছু যাবে আসবে না, তাঁরই বয়সি আরও অগণিত বাঙালির মতো তিনিও চোখে রিডিং গ্লাস লাগিয়ে প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতায় খুঁটিয়ে পড়ে ফেলবেন মোহনবাগান অথবা ইস্টবেঙ্গল নিয়ে যাবতীয় সংবাদ।
রীতিমতো মধ্যবয়সে পৌঁছেও কলকাতার দুই শতবর্ষপ্রাচীন ক্লাব ঘিরে বাঙালির এই অদম্য আবেগ যেমন আমাদের আপ্লুত করে, তেমনটাই আশঙ্কিতও করে বৈকি। কারণ একটাই- যাঁরা কলকাতার ফুটবলের, বিশেষ করে এই দুটি ক্লাবের, গতিপ্রকৃতি দৈনিক ভিত্তিতে লক্ষ করে থাকেন, তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের বিশাল সমর্থককূল ক্রমশ একটি বিশেষ প্রজন্মের মধ্যে আটকা পড়ে যাচ্ছে। সবুজ-মেরুন অথবা লাল-হলুদ রং নিয়ে যে আবেগ, তার অনেকটাই নস্টালজিয়ার বহিঃপ্রকাশ মাত্র, দুই দলের সাম্প্রতিক অতি মাঝারিমানের ফলের সঙ্গে তার তেমন সম্পর্ক নেই। ফলত, ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম, এই মুহূর্তে কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখা যুবক-যুবতীদের এক বড় অংশ কলকাতার ফুটবল নিয়ে ঘোষিতভাবে নির্লিপ্ত।
এই প্রবণতা নিয়ে হা-হুতাশ করবার কিছু নেই, কারণ এটাই ভবিতব্য, এমনটাই বুঝি হবার ছিল। শুনতে কটু শোনালেও মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল আজ প্রায় মৃতপ্রায় দুই ঐতিহ্য, সময়ে সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা চলছে, একথা আজ সান্ত্বনাবাক্য মাত্র, আদতে তারা এক দিশাহীন মরুপথে ধারা হারিয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। এই দুই ক্লাবের একদা অপরাজেয় আখ্যা আজ নিতান্ত ব্যঙ্গের মতো শোনায়, দেশের বৃহত্তম এবং জনপ্রিয়তম দুই জনতার ক্লাব থেকে তারা পরিণত হয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন দুটি কোম্পানিতে। নামের পাশে কলকাতা লেখা থাকলেও এরা উক্ত শহরের স্থানীয় লিগে খেলে না, এদের শতবর্ষপ্রাচীন মাঠ দুটি সারা বছর খাঁখাঁ পড়ে থাকলেও এরা ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে দেশের পশ্চিম উপকূলে; সর্বোপরি এদের অধিকাংশ কর্মকর্তা নিতান্ত নখদন্তহীন, ফুটবলহীন এবং ট্রফিহীন তাঁবুতে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে বসে রাজা-উজির মারা ছাড়া এঁদের দৃশ্যত আর কোনও কাজ নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে এই দুই ক্লাবের আকর্ষণ শূন্য থেকে শূন্যতর হয়ে উঠেছে।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে এই কদিন আগে অবধি গোয়ার মাটিতে আইএসএল খেলতে ব্যস্ত ছিল কলকাতার দুই বড় ক্লাব, এটিকে মোহনবাগান এবং এসসি ইস্টবেঙ্গল নামে। এরা চলেছে সম্পূর্ণ নিজেদের মতো করে, এদের পরিচালনার ভার ন্যস্ত ছিল একদল লোকের হাতে, যাঁদের যাবতীয় দায়বদ্ধতা মূলত দুটি কোম্পানির মালিকপক্ষের কাছে। কলকাতায় দুটি ক্লাবের তাঁবুতে সভাপতি, সচিব, কর্মসমিতির সদস্য ইত্যাদি গালভরা পদ অধিকার করে এবং আলো করে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের আসলে না আছে কোনও ক্ষমতা, না আছে ফুটবল দলের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ। পাড়ার ক্লাবে পরিণত। সুতরাং নেই কাজ তো খই ভাজ- কেউ গড়ছেন হকি দল, আবার কেউ বা রাতারাতি হয়ে উঠেছেন মহিলা ফুটবলের অদম্য উত্সাহদাতা।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গত কয়েকদিন যাবৎ টেলিভিশনের রিমোট টিপলে অথবা খবরের কাগজের পাতা উলটোলে যা দেখা যাচ্ছে, তা ফুটবলকে মানুষের মন থেকে আরও অনেকটাই দূরে সরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। দেখা গেল ১৩৩ বছরে পা দেওয়া মোহনবাগান ক্লাবের নির্বাচন ঘিরে অতি নিম্নরুচির ধুন্ধুমার কাণ্ড, লাঠি ও ক্রিকেট ব্যাট যথেচ্ছ ব্যবহার করে খণ্ডযুদ্ধ, ক্লাবের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা অচেতন যুবকের ছবি। ভূলুণ্ঠিত ঐতিহ্যের ধ্বজাধারী ক্লাবের যাবতীয় সম্মান, তথাকথিত জাতীয় ক্লাব করুণ পরিণতির দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, তার ছবিটা ক্রমশ স্পষ্টতর। এ এমন এক নির্বাচন, যার কোনও গুরুত্ব নেই। নির্বাচিত কর্তারাও ঢালহীন ক্ষমতানহীন নিধিরাম সর্দার। তাতেই এমন লজ্জার মারপিট।
মোহনবাগান ক্লাব থেকে হাঁটাপথে ইস্টবেঙ্গল- এমন একটি মাঠে, যেটি গত শতাব্দীর ষাট দশকের মধ্যভাগ অবধি ছিল দুই ক্লাবের এজমালি মাঠ। আজ সেই ক্লাবেও ফুটবল হয় না, হয় গেটের বাইরে দুই দল সমর্থকদের মধ্যে মারামারি, গোলমাল থামাতে পুলিশের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। এই ক্লাবের কর্তারাও ফুটবল দল গড়তে পারেন না, ট্রফি আনতে পারেন না; কিন্তু চরম অব্যবস্থার সৃষ্টি করতে এঁরা অতীব পারঙ্গম- তা সে লগ্নিকারী কোম্পানিকে তাড়াতেই হোক, কি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিরোধীপক্ষকে বেসামাল করে দিতেই হোক, অথবা পেটোয়া সমর্থকদের জোগাড় করে প্রতিপক্ষকে হুমকি দিতেই হোক। এঁদের কাছে যাবতীয় কলাকৌশল সদাসর্বদা মজুত- ব্যতিক্রম শুধু ফুটবল। সেখানেও নির্বাচন নিয়ে চলে ছেলেখেলা।
এরপরেও যাঁরা আশা করেন আবার ফিরবে সুদিন, স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে বাঙালির দুই প্রাণের ক্লাব, তাঁরা হয় বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন না, না হয় নিজেদের মনকে প্রবোধ দিচ্ছেন মাত্র। কারণ মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল আজ শুধুমাত্র বহির্বঙ্গে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা হারিয়েছে তাই নয়, ঘরের মাটিতেও আজ তারা এক গভীর সংকটের মুখোমুখি।
একটু ভেবে দেখলেই উপলব্ধি হবে, নতুন প্রজন্মের কাছে কলকাতার দুই বড় ক্লাব ক্রমশ দুটি অপরিচিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। এদের প্রথম একাদশে স্থানীয় ফুটবলারদের সংখ্যা দ্রুতগতিতে কমছে, এদের মাঠে মাসের পর মাস খেলা হয়না, এরা স্থানীয় প্রতিযোগিতায় খেলতে সর্বদা বিমুখ, বাংলার মানুষের কাছে এদের উপস্থিতি এখন শুধু টেলিভিশনের পর্দায়। কী দেখে আকর্ষিত হবে নতুন প্রজন্ম? শুধুই অতীত গৌরবের কাহিনী আর কতদিন সদ্যযৌবনে পা দেওয়া বাঙালি তরুণ-তরুণীকে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মোহে বেঁধে রাখতে পারবে? ক্লাব বলতে এঁরা শুধু দেখছেন কর্তাদের ফাঁপা বুলি, নির্বাচন ঘিরে কোন্দল, এবং আগ্রাসী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই নিম্নগামী পরিবেশে সচেতনভাবে প্রবেশ করতে চাইবেন?
তবে পথ কি নেই? আছে অবশ্যই। সময়ে দাবি মেনে কিছুটা হয়তো কর্পোরেটের হাতছানিতে সাড়া দিতে হবে, কিন্তু তারই পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে সমান্তরাল সুস্থ পরিবেশ- যাঁরা লগ্নিকারীদের সাহায্য নিলেও তাঁদের অন্যায় দাবিকে অগ্রাহ্য করে ক্লাবকে স্বাধীনভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু তেমন মানুষ আজ কোথায়, আর কেই বা তাঁদের ঢুকতে দিচ্ছে? আপাদমস্তক বাঙালির মনে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল আজও প্রাসঙ্গিক, এই দুর্দিনেও তাঁরা নিভৃতে বলেন, আমার অনাগত আমার অনাহত, তোমার বীণা-তারে বাজিছে তারা, জানি হে জানি তাও হয়নি হারা। তবু ভয় হয়, একথা বলার দিনও সম্ভবত শেষ হয়ে আসছে।
(লেখক সাংবাদিক)