ইতালি – ০
উত্তর ম্যাসিডোনিয়া – ১ (ত্রাজকোভস্কি)
পালের্মো : ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বে বলকান প্রদেশের এক ছোট্ট দেশ, নয়ের দশকের শুরুতে কোনও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়াই যার জন্ম অবিভক্ত যুগোস্লাভিয়ার বুক চিরে। যার অতীত ইতিহাসে চোখ রাখলে ভেসে ওঠে নানা সোনালি অধ্যায়।
বৃহস্পতিবার রাতের পর সেই ছোট্ট দেশের নাম মুখেমুখে ঘুরছে গোটা বিশ্বজুড়ে, অবাক বিস্ময়ে। চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালিকে বিশ্বকাপের যোগ্যতাঅর্জনের দৌড় থেকে ছিটকে নতুন এক ইতিহাস তৈরি করেছে উত্তর ম্যাসিডোনিয়া। ইউরো কাপ জয়ী রবার্তো মানচিনির ইতালির বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে অদম্য লড়াই। ম্যাচের সংযুক্তি সময়ে (৯০+২ মিনিট) আলেকজান্ডার ত্রাজকোভস্কির দুরন্ত গোল। বাকিটা এক অসাধ্যসাধনের গল্প। ম্যাচ শেষে পালের্মোর গ্যালারি শুধুই লাল রোশনাইয়ে মোড়া। তার অতলে চাপা পড়ে গিয়েছে নীল আজুরির হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা।
ঠিক ২৫৭ দিন আগে ছবিটা ছিল ঠিক উল্টো। ওয়েম্বলির লাল স্টেডিয়াম তখন নীল উল্লাসে মোতায়ারা। ইউরো কাপ জিতে ইতালির নবজন্ম ঘটিয়েছেন রবার্তো মানচিনি। লিওনার্দো বনুচ্চি, জর্জিও চিয়েলিনির মতো ইতালীয় রক্ষণের স্তম্ভদের মুখে তখন ইটস কামিং রোম-এর জয়ধ্বনি। চোখে স্বপ্ন ২০১৮-র বিশ্বকাপে খেলতে না পারার যন্ত্রণা ঘুচিয়ে দেশকে কাতারের ছাড়পত্র এনে দেওয়ার।
বৃহস্পতিবার রাতে ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সেই মানচিনিকে দেখা গেল মাথা নীচু করে টানেলের দিকে হাঁটতে, চোখে ধরা গভীর শূন্যতা। অধিনায়ক চিয়েলিনি তখন সবুজ ঘাসে মুখ ঢেকেছেন। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন জর্জিনহো, মার্কো ভেরাত্তিরা। বিধ্বস্ত, বিপন্ন প্রতিটি নীল আজুরি জার্সি।
২০১৮-তে বিশ্বকাপের যোগ্যতাঅর্জন পর্বে দুই লেগের লড়াইয়ে সুইডেনের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ইতালির। ব্যর্থতার দায় কাঁধে বিদায় নিয়েছিলেন তৎকালীন কোচ জিয়ান পিয়েরা ভেঞ্চুরা। এবার কি মানচিনির পালা? ইতালিকে টানা ৩৭ ম্যাচ অপরাজিত রাখা প্রফেসর যেন হজম করতে পারছেন না উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার কাছে হারকে। বললেন, ইউরো জয়টা যেমন জীবনের সবচেয়ে খুশির মুহূর্ত, এটা তেমনই সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা। আমাদের সত্যি কিছু বলার ভাষা নেই। যা হয়েছে তা অবিশ্বাস্য।
ইউরো কাপ জিতেও বিশ্বকাপে নেই, এমন নজির ইতালির আগে রয়েছে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া (১৯৭৬), ডেনমার্ক (১৯৯২) ও গ্রিসের (২০০৪)। মানসিকভাবে গোটা দল যে ভেঙে পড়েছে, মানছেন মানচিনি। তাঁর কথায়, আমাদের একনম্বরে থাকার কথা। তারপরে এই ফলাফল মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
আত্মবিলাপের সুর জর্জিনহোর গলায়। গ্রুপ পর্যায়ে সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে জোড়া পেনাল্টি নষ্ট করেছিলেন ইতালীয় মিডফিল্ডার। তারপর প্লে অফে এই বিপর্যয়। নিজেকে দোষারোপ করে জর্জিনহো বলেন, পেনাল্টি নষ্টের জন্য নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। বাকি জীবন এই অনুশোচনা আমাকে তাড়া করে যাবে। পাশাপাশি বিশ্বকাপের প্লে অফের সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়াকে দুঃস্বপ্নের সঙ্গে তুলনা করেছেন জর্জিনহোর সতীর্থ ভেরাত্তি।
হাহাকারে মোড়া ইতালির উল্টোমেরুতে দাঁড়িয়ে উত্তর ম্যাসিডোনিয়া। ২০১৭-তে ফিফা ক্রমতালিকায় ১৬৬ নম্বরে থাকা দেশের সামনে এখন প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলার হাতছানি। গতবছর বিশ্বকাপের যোগ্যতাঅর্জন পর্বে গ্রুপ পর্যায়ে জোয়াকিম লো-র জার্মানিকে হারিয়ে চমকে দিয়েছিল উত্তর ম্যাসিডোনিয়া। এবার ইতালি।
সামনের লড়াই আরও কঠিন। কাতারে বিশ্বকাপ খেলতে গেলে প্লে অফের ফাইনালে পর্তুগালকে হারাতে হবে। আলেকজান্ডারের উত্তরসূরিদের পেরোতে হবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নামক পাহাড়ের বাধা। পারবেন কি তারা আরও একটা অঘটনের রূপকথা লিখতে? অপেক্ষা সেই উত্তরের।