নীরেন্দ্রনারায়ণ দাশ, শামুকতলা : স্মার্টফোনে আসক্তি নিয়ে অশান্তি নেই, এমন পরিবারের সংখ্যা খুবই কম। স্মার্টফোন যে পড়ার অভ্যাস বদলে দিচ্ছে, সেকথা এখন সকলেই মানেন। কিন্তু এর উলটো ছবি দেখা যাবে আলিপুরদুয়ার-২ ব্লকের টটপাড়া-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রামীণ গ্রন্থাগারে গেলে। ওই গ্রামের ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতিরা স্মার্টফোনে বুঁদ না থেকে বই পড়তে দৌড়োচ্ছেন গ্রামীণ গ্রন্থাগারে। বিকেল হতেই তাঁদের দেখা মিলছে গ্রন্থাগারে। আশপাশের বিদ্যালয় ছুটির পর পরিচ্ছন্ন গ্রন্থাগারের তিনটি ছোটো ঘরে তিলধারণের জায়গা থাকছে না। সেখানে গেলে দেখা যাবে সবাই নীরবে বই পড়ছেন। যাঁরা বসার জায়গা পাচ্ছেন না তাঁরা পছন্দমতো বই বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন।
গ্রন্থাগারের একমাত্র কর্মী গ্রন্থাগারিক কল্যাণ রায় দক্ষতার সঙ্গে সবদিক সামলাচ্ছেন। তাঁকে সহযোগিতা করছেন গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতির অন্য সদস্যরা। এই গ্রন্থাগারে বই ধরো বই পড়ো প্রকল্পে ৩৮০ জন শিশুর নাম আছে। এছাড়া সাধারণ পড়ুয়া বিভাগে ১৫২ জন, বয়স্কদের বিভাগে ৪ জনের নাম নথিভুক্ত রয়েছে। এখানে স্থানীয় পড়ুয়া ছাড়াও ভাটিবাড়ি, মজিদখানা উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরাও আসেন। তেমনই আসেন কামাখ্যাগুড়ি শহিদ ক্ষুদিরাম কলেজ, শামুকতলা সিধু কানু কলেজের ছাত্রছাত্রীরা।
গ্রন্থাগারে মোট বইয়ে সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। বেশিরভাগ বাংলা আর ইংরেজি ভাষার বই। পাঠ্যপুস্তক ও গল্পের বইয়ে পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন পরীক্ষা যেমন- আর্মি, স্কুল সার্ভিস, নেট, রেলের পরীক্ষার বিভিন্ন বইও এখানে আছে। গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতির সভাপতি সুনীলকুমার দাস বলেন, ২০০৭ সালে কল্যাণবাবু এখানে গ্রন্থাগারিক হয়ে আসার সময় মাত্র একটি ঘর ছিল। পাঠকের সংখ্যাও ছিল খুব কম। তাঁর উদ্যোগে এবং পঞ্চায়েত সমিতির সহযোগিতায় এখন তিনটি ঘর হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ওই গ্রন্থাগারে যেমন ভালো বই রয়েছে, তেমনই গ্রন্থাগারিক ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বিভিন্ন বিষয় বুঝিয়ে দেন, পড়ুয়াদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতাও করেন। শিশুদের আকৃষ্ট করতে কার্টুন ও মজার মজার বইয়ে সংখ্যা কম নয়। এখানে ছাত্রছাত্রীদের মনোরঞ্জন করতে অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পড়ুয়ারাও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়।
প্রধানত এইসব কারণেই পড়ুয়াদের ভিড় লেগে থাকে গ্রামীণ এই গ্রন্থাগারে। দশম শ্রেণির পড়ুয়া নয়নমণি সিংহ, পূজা রায়, বৃষ্টি রায় জানাল, এখানে বিভিন্ন সহায়ক বই তারা পায়। একই কথা জানিয়েছে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা। দীপা রায়, অনুরাধা সূত্রধর, রুম্পা সাহার বক্তব্য, কল্যাণ স্যরের জন্যেই তাদের বই পড়ার আগ্রহ জন্মেছে। কামাখ্যাগুড়ি শহিদ ক্ষুদিরাম কলেজের পড়ুয়া সুকান্ত দাস, অম্লান দত্ত, জাহ্নবী দাস জানান, তাঁরা সামরিক বাহিনীতে বা প্রশাসনে যোগদান করতে আগ্রহী এবং তার জন্য তৈরি হচ্ছেন। এখানে তাঁরা যেমন বিভিন্ন সংবাদপত্র বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন বইও পাচ্ছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজু চক্রবর্তী, লোকশিল্পী আন্না বড়ুয়া, মুন্না পাল ছেলেমেয়েদের স্মার্টফোনের বদলে বইমুখী করে তোলার জন্য গ্রন্থাগারিক ও পরিচালন সমিতির ভূয়সী প্রশংসা করেন।
গ্রন্থাগারিক কল্যাণ রায় বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতি, স্থানীয় গ্রামবাসী, প্রশাসন ও বর্তমান পঞ্চায়েত সমিতির সহযোগিতায় আমরা আজ এখানে আসতে পেরেছি। আমাদের গ্রন্থাগারে পানীয় জলের ব্যবস্থা, ছাত্রছাত্রীদের জন্যে পৃথক শৌচাগার, কম্পিউটার সবই আছে। আমাদের এখানে যাঁদের নাম নথিভুক্ত আছে, তাঁরা সকলেই গ্রন্থাগারে নিয়মিত আসেন। এই বছরের শ্রেষ্ঠ জেলা গ্রন্থাগারের সম্মান আমরা পেয়েছি। আর শ্রেষ্ঠ পাঠক আমাদেরই গ্রন্থাগারের পাঠক অপর্ণা রায়। আলিপুরদুয়ার জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক শিবনাথ দে বলেন, পড়ুয়াদের গ্রন্থাগারমুখী করতে গ্রন্থাগারিক কল্যাণ রায় ও অন্য সদস্যদের অবদান অনস্বীকার্য। এই গ্রন্থাগার শহরের বড়ো বড়ো গ্রন্থাগারের কাছে অনুপ্রেরণা। এই গ্রন্থাগারের উপর আমাদের বিশেষ নজর আছে।