প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ গত মার্চ মাসে ভারত থেকে উড়ে ‘ভুলবশতঃ’ পাকিস্তানে আছড়ে পড়েছিল একটি সুপারসনিক মিসাইল। পাকিস্তান দাবি করেছিল, ভারতের এই মিসাইলে কোনও বড়রকমের প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয় যথেষ্ট। ভারতও এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। ১৫ মার্চ সংসদে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং (Rajnath Singh) বলেছিলেন, এই ঘটনা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। ভারত যেকোনো অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগে যথেষ্ট সাবধানী। তবু এমন একটি ঘটনা, যা সম্পূর্ণ তদন্ত করে দেখা হবে ও কোথায় ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে খতিয়ে দেখা হবে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পরবর্তী কালে তার সেই আশ্বাসবাণী ঠাঁই পায় সরকারের ‘পেন্ডিং লিস্ট’ বা বকেয়া তালিকায়।
সরকারি প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাসবাণীর ‘পেন্ডিং লিস্ট’ বা বকেয়া তালিকায় জমা পড়ার ঘটনা নতুন নয়। প্রহ্লাদ জোশির (Prahlad Joshi) কেন্দ্রীয় সংসদীয় কার্যনির্বাহী মন্ত্রক জানাচ্ছে, চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত নিম্ন কক্ষ বা লোকসভায় ১০০৫ টি ও রাজ্যসভায় ৬৩৬ টি ‘আশ্বাস’ আজও রয়ে গেছে অপূর্ণ। অর্থাৎ শুধুই আশ্বাসবাণী দিয়ে দায় সেরেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা, বাস্তবে তা পূরণ আর হয়নি। সংসদীয় বিধিনুযায়ী, সংসদের উভয়কক্ষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস, সচরাচর তিন মাসের মধ্যে পূরণ করাই এর নিয়ম। যদি তিন মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয় প্রতিশ্রুতি পূরণে সক্ষম না হয়, সেক্ষেত্রে বাড়তি আরও তিন মাস সময়, আবেদনের ভিত্তিতে তারা পেতে পারেন। কিন্তু ৬ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও, যদি মন্ত্রক প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে সে ক্ষেত্রে মন্ত্রকের ‘বকেয়া তালিকা’য় জমা হয়।
কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ১০ বছরের বেশি সময়ে সংসদের নিম্নকক্ষে বা লোকসভায় ৩৮ টি সরকারি আশ্বাস আজও বকেয়া, ৫ বছরের বেশি পুরনো ১৪৬ টি ও তিনবছরের পুরনো ১৮৫ টি এ জাতীয় প্রতিশ্রুতি আজও অসম্পূর্ণ। লোকসভায় আইন প্রণয়ণ মন্ত্রকে সর্বাধিক ৮২ টি, রেলে ৬১ টি, শিক্ষায় ৫৬, প্রতিরক্ষায় ৫০ টি, সড়ক পরিবহনে ৪৮ টি সহ অর্থমন্ত্রকে ৩৯ টি, পর্যটনে ৩২ তথা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকে ৩১ টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস বাকি রয়েছে। রাজ্যসভাও তথৈবচ। সংসদীয় ভূমিতে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাসবাণী, কেন আজ পর্যন্ত পূর্ণ করা সম্ভব হল না, সেই নিয়ে জল্পনা ছড়িয়েছে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক মহলে। বলার অপেক্ষা রাখে ন, সংসদীয় পরিসরে কেন্দ্রীয় স্তরে আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আশ্বাস খতিয়ে দেখতে রয়েছে একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র সংসদীয় কমিটিও (কমিটি অফ অ্যাসিউরেন্স) যা প্রত্যেক অধিবেশনের শেষে এই আশ্বাসবাণীর বাস্তবতা খতিয়ে দেখে বা পুনর্মূল্যায়ন করে থাকে। মেরঠের বিজেপি সাংসদ রাজেন্দ্র আগরওয়ালের নেতৃত্বাধীন ১৩ জন সদস্যের এই কমিটিতে রয়েছেন বাংলার দুই প্রতিনিধি – বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় ও বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু।
কেন বকেয়া রয়েছে এই পাহাড়প্রমাণ প্রতিশ্রুতি, তা বলতে গিয়ে সৌগত রায় জানান, বিরাট পরিমাণ এ-ই বকেয়া প্রতিশ্রুতি প্রমাণ করে কেন্দ্র সরকার আদৌ প্রতিশ্রুতি পূরণে আগ্রহী নয়। তারা যা বলে তা শুধুই মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এই মানসিকতা তীব্র নিন্দনীয়৷ অন্যদিকে মালদার সাংসদ খগেন মুর্মুর যুক্তি, আসমুদ্রহিমাচল গোটা দেশের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের কাঁধে। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে মোদী সরকার সর্বদা তৎপর। পাহাড়প্রমাণ কাজের চাপে জেরবার ২৪টি মন্ত্রক। কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি বলে এটা নয়, সরকার হাত গুটিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে সমস্ত প্রতিশ্রুতি সঠিক সময়ে বাস্তবায়িত হবে। অতীতেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কমিটির অন্যতম সদস্য, কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ বলেন, সরকারপক্ষ তাদের হিতকর্তব্য নিয়ে কতটা উদ্যোগী, বিরাট পরিমাণ এই অপূর্ণতার তালিকা তার প্রমাণ৷ ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ – তত্ত্ব এখানে এসে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এদিকে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনেও পুনরায় শয়ে শয়ে আশ্বাসবাণী ও প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হবে দেশ, প্রত্যাশিত ভাবেই। প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার এই সুবিস্তৃত তালিকা (পেন্ডিং লিস্ট) দেখে আদৌ সে সব কতদূর বাস্তবায়িত হবে, সে নিয়েই শাসক ও বিরোধী মহলে শুরু হয়েছে তর্জা।