সৌরভ দেব, জলপাইগুড়ি : ওদের দেখলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়বেই পড়বে। একটা সময় বাড়িতে গ্যাসল্যাম্পের খরচ জোগানো তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিদ্যাসাগর তাই রাস্তার আলোয় নীচে গিয়ে পড়াশোনা করতেন। তাঁর এহেন ‘কীর্তি’ আমাদের বছরের পর বছর ধরে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আজও জোগায়। পেট্রোল পাম্পের এলইডি লাইটপোস্টের নীচে বসে মন দিয়ে পড়াশোনা করে চলা দুই ভাইবোনও হয়তো একদিন সবাইকে জোগাবে।
যে কোনও সন্ধ্যায় জলপাইগুড়ি পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বালাপাড়া ৩১ডি জাতীয় সড়কের পাশে সেই পেট্রোল পাম্পের সামনে গেলেই ওদের দেখা মিলবে। কী কারণে আজকের দিনে এমন ঘটনা? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বছরের পর বছর ধরে ওদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। কেরোসিনের কুপিই ভরসা। কিন্তু খোলাবাজারে সেই কেরোসিনও আজকাল দুর্মূল্য। সেই খরচ বাঁচাতে দুই খুদে পেট্রোল পাম্পের এলইডি লাইটপোস্টের তলাকেই ওদের ‘রিডিং রুম’ বানিয়ে ফেলেছে।
পাহাড়পুরের বালাপাড়ার বাসিন্দা আপন তন্ত্র পেশায় দিনমজুর। পরিবারে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে। এক মেয়ে দোমোহনিতে দাদুর বাড়িতে থাকে। আপনের বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। পাহাড়পুর এলাকায় ইন্ডিয়ান অয়েলের পেট্রোল পাম্প ঘেঁষে আপনের একচিলতে ঘর। তাতে দরমার ভাঙাচোরা বেড়া আর টিনের চাল। ঘরের ভিতর বিছানার পাশে বালতি রাখা। আপন সেই বালতি দেখিয়ে বললেন, ‘বৃষ্টি হলে চালের ফুটো দিয়ে জল পড়ে। তাই বালতি দিয়ে রাখতে হয়।‘ কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, একসময় তাঁদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। আপনের বাবা নীরেন তন্ত্রের নামেই সেই সংযোগ ছিল। কিন্তু বছর দশেক আগে একবার দেড় লক্ষ টাকা বিদ্যুতের বিল আসে। নীরেন সেই সময় ওই বিল মেটাতে পারেননি। এর জেরে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সংযোগ কেটে দেয়। কাটা সেই সংযোগ পরবর্তীতে আর জোড়া লাগেনি।
নীরেন মারা যাওয়ার পর আপন নতুন করে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য বহুবার সংস্থায় যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু পুরোনো বিল না মেটানো হলে সংযোগ দেওয়া হবে না বলে তাঁকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা নামার পর কেরোসিনের কুপিই পরিবারের ভরসা। সেই কুপিতে কোনওমতে ঘরের কাজকর্ম হয়ে যায়। কিন্তু আপনের ছেলেমেয়েরা ওই আলোয় পড়াশোনা করতে পারে না। তাই সন্ধ্যা নামলেই দুই ভাইবোন বইখাতা নিয়ে পেট্রোল পাম্পের বাতিস্তম্ভের নীচে ছোটে। তন্ত্রর বাড়িতে যে শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ নেই এমনটা নয়, জলের কুয়ো ও শৌচাগারও নেই। আপনের স্ত্রী সবিতা বললেন, ‘আমাদের খুবই সমস্যা। পানীয় জল থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজের জন্য পেট্রোল পাম্প থেকে জল আনতে হয়। এমনকি, পেট্রোল পাম্পের শৌচাগারই আমাদের ব্যবহার করতে হয়। পঞ্চায়েতকে বহুবার বলেছি কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি।‘
কথা প্রসঙ্গে আপন জানালেন, ছেলে রাজ ধর্মদেব হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। মেয়ে রাখি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। আরেক মেয়ে পূর্ণিমা দোমোহনিতে দাদুর বাড়িতেই থাকে। আপন বলেন, ‘এক লিটার কেরোসিন আমরা ১০০-১২০ টাকায় কিনি। ছেলেমেয়েরা কেরোসিনের কুপির আলোয় ভালো করে পড়াশোনা করতে পারে না। যে কারণে বাধ্য হয়ে ওরা পেট্রোল পাম্পের আলোর নীচে বসে পড়ে। আমি চাই যাতে দ্রুত আমার বাড়ির এই সমস্যাগুলো মেটানোর ব্যবস্থা করা হয়।’ একরত্তি রাখি এখনও সেভাবে কিছু বুঝতে পারে না। তার দাদা বলে, ‘বাড়িতে আলো না থাকায় আমাদের এভাবেই পড়াশোনা করতে হয়। অন্য সময় সেভাবে সময় না হলেও বৃষ্টিবাদলার দিনে খুবই ভোগান্তি হয়।’ এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে জয়ী বাবলু বসাকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, ‘যত দ্রুত আপনের বাড়িতে কুয়ো ও শৌচাগারের পাশাপাশি আলোর ব্যবস্থাও করা যায় সেজন্য আমরা চেষ্টা করব।’