রাঙ্গালিবাজনা : পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে ডিমডিমা নদী। একটু দূরেই ভূটান পাহাড়ের সারি। নীচে শুধুই সবুজ আর সবুজ। এমন নৈসর্গিক দৃশ্যপটে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ রঙের লম্বা বাড়িটার নাম ‘হেভেন শেল্টার হোম’। বছর দেড়েক ধরে এই স্বর্গতেই আছেন উমাদেবী। ডিমডিমা নদীটার তীরে এখন কাশফুলের ছড়াছড়ি। দোরগোড়ায় মৃণ্ময়ী উমার আবাহনের লগ্ন। কিন্তু ডিমডিমার তীরে স্বর্গে বসেও রক্তমাংসের উমাদেবীর চোখ অশ্রুসিক্ত। সত্তরোর্ধ উমাদেবীর চোখ সারাদিনই খোঁজে তাঁর সন্তানকে। তবে, ঠিকানাটাই ভুলে গিয়েছেন তিনি ।
সন্তানকে খুঁজে চলেছেন ৯০ পার হওয়া কুমোদেবীও। মাস আটেক আগের কথা। ইসলামপুরের রাস্তায় পড়ে ছিলেন ওই বৃদ্ধা। তারপর তাঁর ঠাঁই হয় আলিপুরদুয়ার জেলার বীরপাড়ার হেভেন শেল্টার হোমে। ডিমডিমার সমাজসেবী সাজু তালুকদারের পরিচালিত হেভেন শেল্টার হোমে ঠাঁই তো পেয়েছেন কুমোদেবী। কিন্তু ঠিকানা ভুলে গিয়েছেন তিনিও। মাঝে মাঝে ”ননী, ননী” বলে ডেকে কেঁদে ওঠেন তিনি। ননী নাকি তাঁর ছেলের নাম ।
ছেলেদের কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই চোখ ভিজে যায় অশীতিপর দুই বৃদ্ধা বারুণী চৌধুরী ও কমলা মজুমদারেরও। বছর দু’য়েক আগে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে দুজনেরই ঠাঁই হয় হেভেন শেল্টার হোমে। অসমের তেলাম নামের জায়গার নাম ছাড়া নির্দিষ্টভাবে ঠিকানা বলতে পারেন না বারুণীদেবী। ওডিশা ছাড়া ঠিকানা বলতে পারেন না কমলা মজুমদারও। বীরপাড়া হাসপাতালে দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর বছর দেড়েক ধরে ওই শেল্টার হোমেই রয়েছেন ষাটোর্ধ সোমাই খাড়িয়া। ছেলেধরা সন্দেহে কালচিনিতে গণপিটুনির শিকার হওয়ার পর মাস চারেক ধরে এখানে রয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ বেবী রায়। এরা কেউই ঠিকানা বলতে পারেন না। ঠিকানা তো দূরের কথা, নামটাই আজ পর্যন্ত বলতে পারেননি বছর পঞ্চান্নর এক মহিলা। তাঁর ভাষাই আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেননি আশ্রয় গৃহের কর্ণধার সাজু তালুকদার। সাজুবাবু ওই মহিলার নাম দিয়েছেন ‘পি’।
একসময়ের গাড়িচালক সাজু তালুকদার পথেঘাটে পড়ে থাকা মানুষদের জন্য তৈরি করেছেন আশ্রয়। আলিপুরদুয়ারের বীরপাড়া থানার ডিমডিমা চা বাগানের পাশে চারজন সমাজসেবী মিলে জমি কিনে দিয়েছেন আশ্রয়ের জন্য। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে টিনের চালা দেওয়া ঘর। সাজুবাবু বলেন, ‘মহিলা ও পুরুষ মিলিয়ে মোট ১৬ জন আবাসিক রয়েছে আশ্রয়গৃহে। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় ওদের অন্নের সংস্থান হচ্ছে। কিন্তু ওদের ঠিকানা না মেলায় ঘরে ফেরানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে, মায়েরা চাইছেন ছেলের মুখ দেখতে। কিন্তু, আমি নিরুপায়।’
ছবি- আশ্রয়ে ঘর হারানো মায়েরা।
তথ্য ও ছবি- মোস্তাক মোরশেদ হোসেন