পুলকেশ ঘোষ, কলকাতা : হঠাৎ শুনলে অবাক হতে হবে। অতি সরল বাক্য ‘গরমে আম পাওয়া যায়’ বানান করে পড়তে পারছে প্রথম শ্রেণির মাত্র ৬৬ শতাংশ পড়ুয়া। অথচ ২০১৮-তেও অন্তত ৭৩ শতাংশ পড়ুয়া নির্ভুল উচ্চারণে বাক্যটি পড়তে পারত। দ্বিতীয় শ্রেণির অবস্থাটা আরও ভয়াবহ। যুক্তাক্ষরহীন, কিন্তু কিছুটা বড় বাক্য এখন পড়তে পারে মাত্র ৫৩ শতাংশ। তিন বছর আগে অর্থাৎ করোনাকালের আগে এই পারার হার ছিল ৬৬ শতাংশের বেশি।
সাম্প্রতিক এক বেসরকারি সমীক্ষায় এমন অনেক উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আর দেরি না করে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি রাজ্য সরকারের করোনা মোকাবিলায় গঠিত গ্লোবাল অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য। বুধবার তিনি বলেন, এখনকার কোভিড পরিস্থিতি স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে অনুকূল। এখন খোলা হাওয়াতে ক্লাস করা সম্ভব। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে স্কুল খোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আর দেরি না করে সব স্কুল খুলে দেওয়া হোক।
যেভাবে সপ্তম, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা পড়তে, লিখতে ভুলে যাচ্ছে, তাতে চরম বিপর্যয়ে আশঙ্কা করছেন অভিজিৎ। এই আশঙ্কার কারণ বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্টটি, যা থেকে জানা গিয়েছে যে, শুধু প্রথম বা দ্বিতীয় নয়, সপ্তম শ্রেণির অনেক পড়ুয়াও ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা চিনতে পারছে না। অঙ্ক কষা তো পরের কথা। সমীক্ষকদের মতে, এমন পড়ুয়া করোনাকালের আগেও ছিল। কিন্তু অজ্ঞানতার হার ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৮-তে সপ্তম শ্রেণির ১ শতাংশ পড়ুয়া সংখ্যা চিনত না। সেই হার এখন আড়াই শতাংশ।
এমন অজ্ঞানতা নীচের ক্লাসে আরও বেশি বলে সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। এখন ষষ্ঠ শ্রেণির ৫.৩, পঞ্চম শ্রেণির ৫.২, চতুর্থ শ্রেণির ৬.৭, তৃতীয় শ্রেণির ৯.২, দ্বিতীয় শ্রেণির ১২.৬ এবং প্রথম শ্রেণির ৩০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা ঠিকঠাক চিনতে পারছে না। পরিস্থিতি দেখে রাজ্য সরকারের গ্লোবাল অ্যাডভাইজারি কমিটির আরেক সদস্য অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, অনেক হয়েছে। এবার কোভিডবিধি মেনে স্কুল খুলে দেওয়া হোক।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি স্কুল,কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ক্লাসের দরজা খোলেনি। খোলা জায়গায় পাড়ায় শিক্ষালয় প্রকল্পে তাদের পড়াশোনা করানোর কিছুটা উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়কের মতে, এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। শিক্ষামহলের মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি সমীক্ষা রিপোর্টটি। বুধবার অনলাইনে রিপোর্টটি প্রকাশ করেন অভিজিৎ।
অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট (এসার) চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, স্কুল পড়ুয়ারা পড়াশোনার দিক থেকে গত দুবছরে কতটা পিছিয়ে গিয়েছে। গতবছরের ডিসেম্বরে রাজ্যের ১৮টির মধ্যে ১৭টি জেলায় সমীক্ষা করে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। ৫১০টি গ্রামে ১১,১৮৯ পড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলে সমীক্ষকরা রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। সমীক্ষক সংস্থার তরফে রুক্মিণী বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সাধারণ পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বুনিয়াদি শিক্ষায় পড়ুয়ারা প্রায় ৬-৭ বছর পিছিয়ে গিয়েছে। এই সময় স্কুলের খাতায় অনেক ছাত্রছাত্রীর নাম উঠেছে ঠিকই, কিন্তু পড়াশোনার মানের নিরিখে ছবিটা খুব হতাশাজনক।
রুক্মিণী বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণির মানের সাধারণ লেখাও তৃতীয় শ্রেণির ৩০ শতাংশ পড়ুয়া পড়তে পারছে না। এমনকি পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের অর্ধেক ওই লেখা পড়তে পারেনি। তৃতীয় শ্রেণির মানের বিয়োগ অঙ্ক অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের অর্ধেক কষতে পারছে না। অষ্টম শ্রেণির ৬০ শতাংশ পড়ুয়া তৃতীয় শ্রেণির মানের ভাগ অঙ্ক কষতে পারেনি। এই পরিস্থিতি দেখে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের পরামর্শ, এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা আপাতত সিলেবাস শেষ করার লক্ষ্য ভুলে যান। আগে পড়াশোনার মান নির্ধারণ করে সেই জায়গা থেকে টেনে তুলে বর্তমান ক্লাসের উপযোগী করে তুলুন ছাত্রছাত্রীদের। অন্তত ৩-৪ মাস সিলেবাসের কথা ভাবাই যাবে না।
এই উদ্যোগে তিনি স্কুলের পাশাপাশি সমাজের সব অংশকে শামিল করার পক্ষপাতী। তাঁর মতে, বিশেষ করে পাড়ার দাদাদের কথা ছোটরা মেনে চলে। তাই তাদের এই কাজে শামিল হতে বলছি। সমীক্ষক সংস্থার তরফে রুক্মিণী বলেন, এই মুহূর্তে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বাচ্চারা ক্লাসে এলে তাদের সদ্য স্কুলে ভর্তি হওয়া শিশুদের মতো পড়াতে হবে। আগে দেখতে হবে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়ারা কী অবস্থায় আছে। তাদের সেই পর্যায় থেকে পড়াশোনা শুরু করাতে হবে। পড়ুয়াদের অবস্থা বুঝে সেভাবে পড়াতে হবে।