রহিত বসু : ঘরবন্দি জীবন কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছিল। এখন রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির লড়াইয়ে আকাশে-বাতাসে বেশ একটা উত্তেজনা উত্তেজনা ভাব এসেছে। অনেকে আবার বলতে শুরু করেছেন, এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় আসল সমস্যা আড়ালে চলে যাচ্ছে না তো! কেউ লিখছেন আম্বেদকরের উদ্ধৃতি, জবাবি চিঠিতে কেউ আবার ইংলিশ চার্চম্যান ও ইতিহাসবিদ থমাস ফুলারের প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগেকার মন্তব্য উদ্ধৃত করছেন। আর এই পাণ্ডিত্যের প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন না, সোশ্যাল মিডিয়ায় কলকাতার বাঙুর হাসপাতালের কথা বলে যে ভিডিওটা চলছে সেটার আদৌ কোনও ভিত্তি আছে, নাকি সেটি পুরোপুরি জাল। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলও ওই ভিডিওর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে। এ সব প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই সরকার কখনও না কখনও দেবে। আমরাও নিশ্চয়ই বুঝে যাব, কোন মৃতু্য়র কারণ করোনা, কোনটার অজানা।
আপাতত আমরা ভবিষ্যতের কথা ভাবি। মুম্বই থেকে এক বন্ধু ফোন করে বললেন, অগাস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুটিং বন্ধ থাকবে বলে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, করোনার মেয়াদ কতদিন, সে ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নন। রাষ্ট্রনায়কদের কথা ছেড়েই দিন, বিজ্ঞানীরাই স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। বন্ধুর ব্যাখ্যা হল, এমন পরিস্থিতিতে সিনেমার ঘনিষ্ঠ দৃশ্য নিশ্চয়ই নায়ক-নায়িকাকে তিন মিটার দূরে দাঁড় করিয়ে শুট করা যাবে না। কলকাতায় যিনি মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ান, তিনিও দেখলাম থিয়েটারের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত। আদৌ কি হাজার লোকের ভিড়ে অভিনয় করা যাবে? নাকি শো বিজনেসের ধরন বদলে যাবে? যাঁরা কর্পোরেট কোম্পানিতে চাকরি করেন, তাঁরা তো প্রতি মুহূর্তে ছাঁটাইয়ে কোপে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন।
ভারতীয় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে মূলধনি খাতে বিনিযোগের পরিকল্পনা স্থগিত রাখার কথা ভাবছেন। যতটুকু দরকার, ততটুকু খরচ। অনেক কোম্পানির কর্তারা পাকাপাকিভাবে ওয়ার্ক ফ্রম হোম পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বিবেচনা করছেন। এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম পদ্ধতিতে উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। যারা খেলার মাঠের ব্যাপারে আগ্রহী, তাঁদেরও একইরকম উদ্বেগ। একবার ভেবে দেখুন, এদেশের আইপিএল অথবা বিদেশের প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে কত কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। কতদিন পর্যন্ত দলবদল বন্ধ রাখতে হবে। আবার কবে ৬০-৭০ হাজার মানুষের ভিড় হবে স্টেডিয়ামে, কেউ বলতে পারেন না। সব কিছুর উপর অনিশ্চয়তার মেঘ। কারণ, এ এক অদৃশ্য শত্রু, একে মারার ওষুধ মানুষের অজানা। একে মোকাবিলা করার একমাত্র জানা পদ্ধতি হল, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা।
করোনার মেঘ যখন সরে যাবে তখন অন্য মহামারি গ্রাস করতে পারে এই পৃথিবীকে। ক্ষুধা, নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্যের মহামারি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে এদেশের গরিব মানুষ বলছেন, করোনা নয়, অনাহারই তাঁদের মৃত্যুর কারণ হবে। রাষ্ট্রসংঘের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছরের শেষে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। রাষ্ট্রসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির অধিকর্তা ডেভিড বারলে বলছেন, অন্তত তিন ডজন দেশে দুর্ভিক্ষ দেখতে হতে পারে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যে অজানা শত্রুর কাছে কতটা অসহায়, করোনার মরশুমে তা প্রমাণিত হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও দুর্দশা অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশের কথাই ধরুন না কেন। সেদেশের বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক একটি সমীক্ষায় দেখেছে, করোনা সংক্রমণের জেরে সরকারি ছুটি অথবা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ৭২ শতাংশ মানুষ হয় কাজ হারিয়েছেন অথবা তাঁদের কাজ কমে গিয়েছে। পরিবারপিছু গড় আয় কমেছে। কারখানার শ্রমিকদের আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। শহরের দিনমজুরের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। রিকশাচালকদের আয় কমেছে ৭২ শতাংশ, পরিচারিকাদের ৬৮ শতাংশ। এবার বড়লোক দেশ আমেরিকার একটি পরিসংখ্যান জানাই আপনাদের। গত ৫ সপ্তাহে সেদেশে ২ কোটির বেশি মানুষ বেকার হয়ে গিয়েছেন।
অথচ দুদিন ধরে নবান্ন আর রাজভবনের মধ্যে যেসব চিঠি নিয়ে লোফালুফি চলছে, তাতে এই সব বিপদের কোনও উল্লেখ আছে? না। সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং অধিকারের কথা আছে, কিন্তু মানুষের অধিকারের কথা নেই। এই যে কত মানুষ বাড়ি ফেরার জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছেন, রাজস্থানের কোটায় পড়তে গিয়ে কত বাচ্চা ও তাদের পরিবার আটকে রয়েছে, সে সব নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।