দেবব্রত চাকী: গুরুগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল গোসানিমারি। দেশের রাজধানী ও কোচবিহার জেলার এই প্রত্যন্ত গ্রামের ব্যবধান দেড় হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে গুরুগ্রামের (পূর্ব নাম গুরগাঁও) অবস্থান। আর গোসানিমারি? সুদূর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্তে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী দিনহাটা মহকুমার একটি গ্রাম।
গোসানিমারি অবশ্য একসময় প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের অন্যতম শাসনকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হত। তার ঐতিহাসিক নিদর্শন এখনও রযে গিয়েছে সেখানে। কিন্তু সেই ঐতিহ্যে তো আর পেটের ভাত জোগার হয় না। জীবনসংগ্রামের অঙ্গ হিসেবে এরকম আরও অনেকের এই পথচলা। ওঁরা কারা? ওদের পরিচয় ওঁরা ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিক। এলাকায় কাজ না পেয়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পেয়ে ওঁরা ভিন রাজ্যে যান। উত্তর থেকে দক্ষিণ, ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই এঁদের দেখা মেলে। এখন এঁদের পোশাকি নাম-পরিযায়ী শ্রমিক। গোসানিমারির যে শ্রমিক বাড়ি ফেরার জন্য হাঁটতে আরম্ভ করেছিলেন, তিনি নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কোচবিহার জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম খলিসা গোসানিমারি ওঁর স্থায়ী ঠিকানা।
করোনা ভাইরাস নামের মারণ সংক্রমণের জেরে লকডাউনের আবহে ওঁর মতো অনেকের এই ঘরে ফেরা ফেরা অভিযান। ওঁদের অন্যতম বাদল হালদার সহ মোট আটজন নির্মাণকর্মী কখনও পুলিশের গাড়িতে, কখনও আলুর ট্রাকে, আবার কখনও হেঁটে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ঘরে ফিরেছেন। বাদল হালদারের মুখে জানা গিয়েছে, গত ২৭ মার্চ গুরুগ্রামে ওঁদের ঝুপড়ির সামনে পুলিশ এসে অনতিবিলম্বে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ। অগত্যা মুহূর্তের মধ্যে বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে পুলিশের গাড়িতেই তাঁদের বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ-বিহার সীমান্তে পুলিশ ওঁদের নামিয়ে দেয়। এরপর বাদল হালদাররা নিজের মতো করে পথ চলতে শুরু করেন। এভাবে চলতে চলতে যাত্রা শুরুর ১২ দিনের মাথায় তাঁরা গন্তব্যে পেঁছোন।
এই বাদল হালদারদের মতো দেশে হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন, যাঁরা রুটি-রুজির টানে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়ার কারণে এখন এক অসহনীয় অবস্থার সম্মুখীন। দিল্লির আনন্দবিহার বাস-টার্মিনাসে লাখো মানুষের জমায়েত আমরা দেখেছি। তাঁরা সবাই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন। পারেননি অনেকে। মুম্বইয়ের বান্দ্রায় জমায়েতের পিছনে যিনি যেরকম ষড়যন্ত্রই দেখুন না কেন, আসল কথা ছিল, পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। হঠাৎ জনতা কার্ফিউয়ের ডাক বা তত্পরবর্তী লকডাউনের কারণে এক চরম যন্ত্রণার সম্মুখীন এঁরা। একদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়, অন্যদিকে ঘরে ফেরার আকুতি তাঁদের দিশেহারা করে তুলেছে। লকডাউনের কারণে উপযুক্ত পরিবহণ নেই বলে বিশাল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক অগত্যা দু-পায়ের ওপর ভর করেই ঘরমুখী হতে চেয়েছেন অনেক জায়গায়।
মিডিয়ায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকদের দলবদ্ধভাবে হেঁটে ঘরে ফেরার এই দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে। উত্তরবঙ্গের অনেককেও বিভিন্ন রাজ্য থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। বিপরীত স্রোতও দেখা গিয়েছে উত্তরবঙ্গ থেকে। ডুয়ার্সের সেনাছাউনিতে কাজ করতে আসা শ্রমিকরা ৩১সি জাতীয় সড়ক ধরে বিহারের উদ্দেশ্যে হেঁটে রওনা হয়েছেন। সেরকম গুয়াহাটি থেকে মালবাহী ট্রাকে চেপে সুদূর রাজস্থানে যাওয়ার পথে একদল শ্রমিককে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ যেন জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের অবস্থা। এই পটভমিতে সব থেকে অবাক করার ঘটনা হচ্ছে পশ্চিম ভারতের রাজ্য গুজরাটে। সেখানকার বস্ত্রশিল্পনগরী সুরাটে বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার শ্রমিক ইতিমধ্যে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। কেউ কাজ হারিয়ে কেউ বেতন না পেয়ে৷
এমনিতে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন, তার ওপর এঁদের নিম্নমানের খাবার বন্টন ক্ষোভকে সপ্তমে পৌঁছে দেয়। কাপড়ের কলে কিংবা নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের বেতনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মালিকপক্ষ কেটে নিয়েছে বলে অভিযোগ। সুরাটে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকরা মূলত ওডিশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ প্রভতি রাজ্য থেকে যান। এদের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক এমব্রয়ডারি ও বস্ত্র কারখানায় বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই শ্রমিকদের সিংহভাগের স্থায়ী ঠিকানা ওডিশা। লকডাউন ঘোষণার পর এঁদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আটকে পড়ে। যার ফলশ্রুতি এঁদের পুঞ্জীভত ক্ষোভের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৩০ মার্চ বাড়ি ফেরার দাবিতে লকডাউন অমান্য করে রাস্তায় নামার মধ্য দিয়ে সেদিন সুরাট পুলিশ ৯০ জন পরিযায়ী শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে বিক্ষোভ দমন করতে সচেষ্ট হয়।
এরপর ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ভিডিও কনফারেন্সে লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দিতেই পুনরায় বাড়ি ফেরার দাবিতে সুরাটের রাস্তায় নেমে পড়েন ক্ষুব্ধ পরিযায়ী শ্রমিকরা। ওডিশা থেকে আগত পরিযায়ী শ্রমিকরাই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। পুলিশ যথারীতি দাঙ্গা ও ১৮৯৭ সালের মহামারী আইনকে অমান্য করার অভিযোগে ৮১ জনকে গ্রেপ্তার করে বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে আম দেশবাসী জানতে পেরেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, সুরাটের রাস্তায় যাঁরা বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন, তাঁদের আসলে অপরাধ কী? তাঁরা ঘরে ফিরতে চাইছেন, এটাই কি অপরাধ? এছাড়া তাঁরা যে কারখানায় কাজ করতেন, সেখানে পাওনা মজুরি দাবি করছেন। সেটাও কি অপরাধ?
হঠাৎ ঘোষিত লকডাউনের জাঁতাকলে পড়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রদত্ত রান্না করা খাদ্যসামগ্রী যাতে একটু সুস্বাদু হয়, সেই দাবি জানিয়েছিলেন ওঁরা। অপরাধের তালিকায় কি সেটাও পড়ে? বাস্তবে কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকটি দাবি মানবিক। দেশের এরকম এক সংকট মুহূর্তে আত্মীয়-পরিজন থেকে শতশত মাইল দূরে কর্মরত এই প্রান্তিক মানুষগুলি এখন দিনের পর দিন বিনিদ্র রাত্রিযাপন করছেন। তাঁদের বিষয়টি গুজরাট সরকারের মানবিক দৃষ্টিতে না দেখে আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে দেখতে যাওয়া কি জরুরি ছিল? বান্দ্রায় এই উদ্বিগ্ন পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর এমন নির্দয় লাঠিচার্জ কি যুক্তিযুক্ত ছিল?
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ ছিল, সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলি যেন তাদের এলাকায় আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের খাওয়া, পরার দায়িত্ব নেয়। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, প্রয়োজনে চিকিত্সা পরিষেবা দেয়। রাজ্য সরকারগুলি কোথাও কোথাও সেই ব্যবস্থা করলেও তা যে প্রয়োজনের তুলনায় কতটা অপ্রতুল, তার বিভিন্ন খবর ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে জানা গিয়েছে। শুধু খাওয়া, পরায় দিন চলে না। যাঁরা ভিন রাজ্যে বাড়ি ভাড়া করে থাকেন, তাঁদের বাড়িভাড়ার টাকা জোগার হবে কোথা থেকে? চাল, ডাল, আলু ইত্যাদি না হয় প্রশাসন দিল, কিন্তু তেল, লবণ, মশলা, সব্জি কেনা হবে কোন টাকায়। ইতিমধ্যে হাতে যাঁর যা সম্বল ছিল, তা শেষ হয়ে গিয়েছে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে কপর্দক শূন্য হয়ে পড়ে থাকার কারণে কেউ যদি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, সেটা কি তাঁর খুব অন্যায়? প্রশাসন এই মানুষদের প্রতি সংবেদনশীল হবে এটাই তো প্রত্যাশিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি পরিযায়ী শ্রমিক পিছু ১০০০ টাকা পকেটমানি দেওয়ার ঘোষণা করেছেন।
সাধু ভাবনা সন্দেহ নেই। কিন্তু কতদিনে সেই সামান্য অর্থ বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা বাংলার শ্রমিকদের হাতে পৌঁছোবে, তা বলা কঠিন। আর যাঁরা পরিবার নিয়ে ভিন রাজ্যে থাকেন, তাঁদের কাছে ১০০০ টাকা খুবই সামান্য। বিপদের সময় এই অর্থ নিশ্চযই তাঁদের কাছে অনেক। অনেকের কাছে এই মুহুর্তে জীবনদায়ীও বটে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দিনের পর দিন লকডাউন চলতে থাকলে এভাবে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কেউ কেউ অসম্ভবও মনে করছেন। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় লকডাউন জরুরি। একই রকম ভাবে বিভিন্ন কারণে ভিন রাজ্যে অবস্থান করা মানুষজন যাতে নিজ নিজ ঘরে দ্রুত নিরাপদে পৌঁছোতে পারে, সেটা সুনিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক দেশের নানাবিধ উন্নয়ন প্রকল্পের মূল বনিয়াদ। এঁরা দেশের নাগরিক। সরকার নির্বাচনে ভোটদাতা হিসাবে এঁদেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলি এঁদের ঘরে ফেরাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাহলে এই সংকটকালে কেন দিনের পর দিন ওঁরা জীবিকাচ্যূত হয়ে বুভুক্ষু অবস্থায় বাড়ি থেকে দূরে এমন কষ্টকর জীবনযাপন করবেন।
আর শুধুমাত্র পরিযায়ী শ্রমিকরাই বা কেন, বহু মানুষ চিকিত্সার কারণে মুম্বই, চেন্নাই, ভেলোর, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ ইত্যাদি স্থানে আটকে পড়েছেন। তাঁদের বিষয়টিও জরুরি ভিত্তিতে সরকারের ভাবা উচিত। বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে যুদ্ধকালীন তত্পরতায় পরিযায়ী শ্রমিক ও এঁদের নিজ রাজ্যে ফেরানো এখন সময়ের দাবি। না হলে সুরাট, বান্দ্রার মতো আরও অনেক ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়। অবশ্যই প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিতে হবে। ট্রেনের মধ্যে করোনার পরীক্ষা করে যাঁদের রিপোর্ট নেগেটিভ থাকবে, তাঁদেরই প্রথম ধাপে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছোতে হবে। বাকিদের প্রয়োজনীয় চিকিত্সা করিয়ে ফেরানোর বন্দোবস্ত করা উচিত। মনে রাখা দরকার কেবলমাত্র বিদেশে কর্মরত কিংবা বিত্তশালী পরিবারের পঠনরত সদস্যরাই নিজ নিজ ঘরে ফেরার হকদার, আর দেশের এই প্রান্তিক মানুষজন ঘরে ফেরার দাবি করলেই অপরাধ এই ভাবনা সর্বৈব পরিত্যাজ্য। আবার ঘরে ফেরানোর পর এঁদের জীবিকা, রুটি-রুজির সংস্থানের ভাবনাও কিন্তু এখনই সরকারের শুরু করা উচিত।