প্রবীর ঘোষাল
চ্যালেঞ্জটা ছিল সরাসরি নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শার সামনে। যদি পাঁচ রাজ্যের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়ত, তাহলে তার প্রধান দায় মোদি-শাকেই নিতে হত, তাতে কোনও সন্দেহ আছে কি? সংঘ পরিবার থেকে শুরু করে পদ্ম শিবিরের সর্বস্তরে নানা চর্চা শুরু হয়ে যেত। প্রশ্ন উঠত, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে কি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে লড়া দলের পক্ষে নিরাপদ হবে? অর্থাত্ সরকারের শীর্ষস্তরে নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতাই বিজেপির অভ্যন্তরে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যেত। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় বিজেপির কর্তারা এই নির্বাচনের ফলাফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।
পাঁচ রাজ্যের মধ্যে গেরুয়া শিবিরের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল উত্তরপ্রদেশ। বিরোধী শিবির থেকে একটা কথা বেশ কিছুদিন ধরে বলার চেষ্টা হচ্ছিল, নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তার গ্রাফ ক্রমশ নিম্নমুখী। মাস দশেক আগে বাংলার বিধানসভা ভোটে শতচেষ্টা করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলকে হারাতে পারেনি মোদি-শা জুটি। বিরোধীদের হাত আরও শক্ত হয়েছিল। জাতীয় রাজনীতিতেও পড়ে গিয়েছিল শোরগোল। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, সদ্য নির্বাচনে পাঁচ রাজ্যের মধ্যে চারটিতে বস্তুত গেরুয়া ঝড় বয়ে গিয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছেও লড়াইটা ছিল কঠিন। কোভিডের সময় গঙ্গায় কাপড় মোড়া অনেক মৃতদেহ ভেসে যাওয়া থেকে শুরু করে হাথরস, উন্নাও এবং লখিমপুর কাণ্ডের মতো ইস্যুতে দেশজুড়ে বিরোধীরা সরব হয়েছিল। যোগীর প্রশাসন অপদার্থ, এই আওয়াজ তুলে আসলে উত্তরপ্রদেশে মানুষের মধ্যে বিজেপি বিরোধী একটা হাওয়া তোলার চেষ্টা চালিয়েছিল কংগ্রেস। যোগীও এসবের মোকাবিলায় সক্রিয় ছিলেন। তার সঙ্গে ছিল সংঘ পরিবারের শক্তপোক্ত সংগঠন। ফুটবল ম্যাচে দেখা যায় কোচদের কেরামতি। টিমের বর্তমান কোচ মোদি-অমিতের ম্যাচ জেতার কৌশল রচনাও ছিল এই যুদ্ধে বিজেপির মস্ত বড় অস্ত্র।
কী সেই কৌশল? হিন্দুত্বের কার্ড খেলতে হবে বেপরোয়াভাবে। কিন্তু শুধু তাতে ভরসা করলে চলবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে যেসব জনমুখী প্রকল্পের সুবিধা রাজ্যের মানুষ পাচ্ছে, সেটাও প্রচারে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। রাজ্যের উন্নয়ন এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নতির রেকর্ডও সমানে বাজিয়ে যেতে হবে।
এই কৌশলকে সামনে রেখেই পদ্ম শিবির উত্তরপ্রদেশের ভোটযুদ্ধে নেমেছিল এক বছরেরও আগে থেকে। যোগী প্রচারে নেমেই বলে দিয়েছিলেন, লড়াই ৮০ বনাম ২০-র মধ্যে। অত্যন্ত সন্তর্পণে হিন্দুত্বের আবেগ তুলে ধরেছিলেন তিনি। তার ফল হল, উত্তরপ্রদেশে পাঁচ বছর আগের থেকে আসন কমলেও, গেরুয়া শিবিরের ভোট বেড়েছে। একটি সমীক্ষা বলছে, হিন্দু ভোটব্যাংকেও সুফল পেয়েছে বিজেপি। ৪৭ থেকে বেড়ে হিন্দু ভোট তাদের পক্ষে গিয়েছে ৫৪ শতাংশ। কোভিডের সময় বিনা পয়সায় খাদ্যদ্রব্য এবং গ্যাস সরবরাহ বর্ণ-ধর্মনির্বিশেষে রাজ্যবাসীকে খুশি করেছে। আরও সব জনমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার সহজেই জনপ্রিয়তার দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বর্তমান সরকারের কঠোর মনোভাব গ্রাম-শহর সর্বত্র যোগীর সরকার প্রশংসা পেয়েছে।
বিহারে ক্ষমতায় এসে নীতীশ কুমার সবচেয়ে বেশি জোর দেন রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। গুন্ডারাজ খতম করতে তিনি সফলও হন। ঠিক সেইভাবে মাফিয়ারাজ রুখতে যোগীও উত্তরপ্রদেশে মানুষের মন জয় করেছেন। এবারের ভোটের আগে অনেক টিভি চ্যানেলে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন প্রান্তে মহিলাদেরও বলতে শুনেছি, এখন আমরা সন্ধ্যা-রাতেও নির্ভয়ে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারি। এমনকি এই কথা মুসলিম মহিলাদের মুখেও শোনা গিয়েছে। এমনিতে সংখ্যালঘু মহিলাদের মধ্যে তালাকের মতো কুপ্রথার বিলুপ্তিও বিজেপির পক্ষে গিয়েছে। তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হল, আলিগড় সহ মুসলিম অধ্যুষিত বেশ কিছু কেন্দ্রে এবার পদ্ম ফুল ফুটেছে।
বিজেপির মোকাবিলায় ওই রাজ্যে বিরোধী শিবিরের ছবিটা কী ছিল? সমাজবাদী পার্টির কর্তা অখিলেশ যাদব গেরুয়া বিরোধীদের এককাট্টা করার সেইভাবে কোনও চেষ্টাই করেননি। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি এবং কংগ্রেসকে তিনি দূরেই সরিয়ে রেখেছিলেন। তার ফলে, বিরোধী ভোট ভাগাভাগির সুবিধা পেয়েছে বিজেপি। মায়াবতীর দলিত ভোটব্যাংকের একটা বড়সড়ো অংশ চলে গিয়েছে বিজেপির দিকে। ফলে মুসলিম ভোটের সিংহভাগ অখিলেশ পেলেও আসন সংখ্যায় সমাজবাদী পার্টি কোনওভাবেই বিজেপির ধারেকাছে যেতে পারেনি। নারায়ণ দত্ত তিওয়ারির কংগ্রেস রাজত্বের ৩৭ বছর পর, টানা দুবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে চলেছেন যোগী আদিত্যনাথ।
অনেকেই মনে করেন, উত্তরপ্রদেশ হল, দেশের রাজনীতির হিন্দি বলয়ের হৃদয়। জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধি, চরণ সিং, চন্দ্রশেখর, রাজীব গান্ধি, অটলবিহারি বাজপেয়ী, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের মতো প্রধানমন্ত্রীই নির্বাচিত হন উত্তরপ্রদেশ থেকে। রাজনৈতিক মহল মনে করে, দিল্লির মসনদে বসতে গেলে, আগে হিন্দি বলয়ের হৃদয় জয় দরকার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মানুষ হলেও, বারাণসী তাঁর লোকসভা কেন্দ্র। তাই বলাই যায়, আগামী লোকসভা ভোটের আগে যোগী আদিত্যনাথরা বিজেপিকে দিল্লি দখলের আগে কিছুটা এগিয়ে দিয়েছেন।
উত্তরাখণ্ডের ভোটেও অধিকাংশ সমীক্ষাই বলেছিল, বিজেপি সেখানে গাড্ডায় পড়েছে। তীব্র প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়ার পাশাপাশি পদ্ম শিবিরের কদর্য কামড়াকামড়ি দেখে সমীক্ষকরা এমনটাই হিসাব করেছিলেন। বিগত এক বছরের মধ্যে দলে বিদ্রোহ থামাতে উত্তরাখণ্ডের তিনবার মুখ্যমন্ত্রী বদল করতে হয়েছিল বিজেপিকে। তবুও প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসকে অনেকটাই পেছনে ফেলে গেরুয়া শিবির জয়ধ্বজা তুলেছে সেখানে।
পঞ্জাব রাজ্যের নির্বাচনি ফলাফল অবশ্যই মস্ত বড় চমক। শাসকদল কংগ্রেসকে কার্যত ধুযেুছে সাফ করে দিয়েছে আম আদমি পার্টি। দিল্লির পর পঞ্জাবের রাজ্যপাটে বসা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পার্টি এই মুহূর্তে একটা নতুন রেকর্ডের অধিকারী হয়েছে। তাদের মতো কোনও আঞ্চলিক দল, দেশের দুটি রাজ্যে এই মুহূর্তে ক্ষমতায় নেই। বিজেপির কাছে পঞ্জাবের অগ্রাধিকার ছিল, তাদের ভোট বাড়ানো এবং কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এক্ষেত্রে বলাই যায়, ওই রাজ্যের ফলাফলে পদ্ম ফুলের পূজারিদের কোনও ক্ষতি হয়নি।
তুলনামূলক ছোট রাজ্য গোয়া এবং মণিপুর। পাঁচ রাজ্যের ভোটে তাদের গুরুত্ব কিছুটা কম ছিল। গোয়ার নির্বাচনে উত্তাপ ছড়িয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের উপস্থিতি। কিন্তু সেখানেও বিজেপির জয়জয়কার। গোয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের ঝগড়ার ফায়দা তুলেছে বিজেপি। গোয়ার পাশাপাশি মণিপুর জয় করে মোদি-শারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, পাঁচ রাজ্যের ভোট ছিল সেমিফাইনাল। ২০২৪ সালের ফাইনাল ম্যাচে গেরুয়া শিবিরই চ্যালেঞ্জ জানাবে বিরোধীদের।
গোয়ার রাজনীতি বরাবরই খুব গোলমেলে। এইরকম একটা রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস কেন পা রেখেছিল, সেটা বেশ কৌতূহলের। ভোটের কদিন আগে ব্যক্তিগত কাজে গোয়ায় গিয়েছিলাম। পানাজি শহরের দক্ষিণ প্রান্তে একটা রেস্তোরাঁয় যাই। সাতজন বাঙালি ছেলে রেস্তোরাঁটি চালান। মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়ার মতো জেলা থেকে অন্নসংস্থানের উদ্দেশ্যেই কয়েক বছর আগে গোয়া যান। তারপর বছর তিনেক হল, মুম্বইয়ের মালিকের কাছ থেকে রেস্তোরাঁটি কিনেছেন ৭ জন। তাঁরা সকলেই একবাক্যে বলেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেস গোয়া নির্বাচনে সেভাবে দাগ কাটতে পারবে না। কারণ সে রাজ্যের রাজনীতি একেবারেই অন্যরকম। ফেরেববাজে ভর্তি। আজ যিনি বিজেপির নেতা, কাল তিনি হয়ে যেতে পারেন কংগ্রেসের বিধায়ক। তৃণমূলের শূন্য হাত দেখে তাই অবাক নই।
(লেখক সাংবাদিক, প্রাক্তন বিধায়ক)