বর্ধমান: লকডাউনের জেরে বিপর্যয় নেমে এসেছে রাজ্যের কৃষিজীবী মহলে। রাজ্যের শস্যগোলা বলে পরিচিত পূর্ব বর্ধমান জেলার কৃষকরাও চরম সমস্যায়। জমিতে ফলানো লংকা, উচ্ছে, কুমড়ো, পটল, ঢেঁড়স প্রভৃতি সবজি আড়তে নিয়ে গিয়ে জলের দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বহু টাকা খরচ করে যে সব চাষিরা সবজির চাষ করেছিলেন তারা এই পরিস্থিতিতে চোখের জল ফেলা ছাড়া অন্য কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁদের সকলের মুখে এখন শুধু একটাই কথা শোনা যাচ্ছে, ‘এমনটা চলতে থাকলে বিষপান করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবেনা।’ পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের বেরু গ্রামপঞ্চায়েত এলাকার সালিমডাঙ্গায় রয়েছে জেলার অন্যতম সবজির আড়ত।
জামালপুর ছাড়াও রায়না, মাধবডিহি ও খণ্ডঘোষের বহু চাষি তাঁদের জমিতে উৎপাদিত সব্জি সালিমডাঙ্গার সবজির আড়তে বিক্রি করতে নিয়ে যান। প্রতিদিন প্রায় ৭০-৮০ টন সব্জির বিক্রিবাটা হয় এই আড়ত থেকে। একই ভাবে কালাড়াঘাটের পাইকারি সবজি বাজারেও প্রতিদিন সকালে সব্জি বিক্রি করতে আসেন বহু চাষি। লকডাউনের আগে পর্যন্ত কলকাতা, শেওড়াফুলি, উল্টোডাঙ্গা সহ আরো বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারেরা এখানকার আড়তে সব্জি কিনতে আসেন। কেনা সবজি মালবাহী গাড়িতে করে সেখানকার বাজারে নিয়ে যেতেন। চাষিরাও লাভজনক দামে সব্জি বিক্রি করে হাঁসি মুখেই বাড়ি ফিরে যেতেন। কিন্তু মারণ করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দেশজুড়ে লকডাউন জারি হতেই সবকিছু উলটপালট হয়ে গেছে। উধাও চাষিদের মুখের হাঁসি।
সালিমডাঙ্গার সবজি আড়তে সোমবার বেলায় পৌছে দেখাযায় বহু চাষি লংকা, উচ্ছে, পটল, কুমড়ো, ঢেঁড়স প্রভৃতি সব্জি নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছেন। সেইসব সব্জি আড়তে নামিয়ে চাষিরা আড়তদারের কাছে গিয়ে সব্জির দাম শোনার পরেই তাঁদের মাথায় হাত পড়ে যায়। চাষিরা বলেন, আড়তদাররা তাঁদের জানিয়ে দিয়েছে লংকা কেজি প্রতি ৪-৫ টাকার বেশি দাম মিলবে না। আর বাকি সব্জির মধ্যে প্রতি কেজি উচ্ছে ৬-৭ টাকা, কুমড়ো ৩ টাকা, পটল ২০-২৩ টাকা ও ঢেঁড়সের দাম ১৮-থেকে ২০ টাকার বেশি মিলবে না। ১৩ জন আড়তদারের কেউই সব্জির দাম একটুও বেশি বলছে না। আড়তে সব্জি বিক্রি করতে আসা রায়নার চাষি শেখ ইয়াকুব, জামালপুরের কনকপুরের চাষি মথু রায়, মধ্যম ঘোষ প্রমুখরা বলেন, ‘লকডাউন জারি হবার পর থেকে ক্রমশ তলানিতে পৌছে যাচ্ছে সব্জির দাম। লকডাউন ঘোষনার আগে তারা আড়তে প্রতি কেজি লংকা ২০-২৫ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এছাড়াও পটল ৪০-৪৫ টাকা ও ঢেঁড়স ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। অন্য সব্জিরও লাভজনক দাম মিলছিল।
চাষিরা বলেন, লকডাউন ঘোষণার পর থেকে সব সব্জির দাম প্রতিদিন তলানিতে নেমে যেতে থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। চাষি শেখ ইয়াকুব বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে লংকা চাষ করতে তাঁদের খরচ করতে হয় ৮-৯ হাজার টাকা। এছাড়াও উচ্ছে কিংবা পটল চাষেও বিঘা প্রতি খরচ লাগে ১০-১২ হাজার টাকা। জমিতে লংকা ফলার পর ৫ কেজি লংকা তোলার জন্য ক্ষেত মজুররা নেয় ২৫ টাকা।’ আক্ষেপ প্রকাশ করে শেখ ইয়াকুব ও মধ্যম ঘোষ বলেন, ‘এত টাকা খরচ করে লংকা চাষ করে এখন ৪টাকা কেজি দরে লংকা বিক্রি করতে হচ্ছে। চাষিরা বলেন, ‘লকডাউনের জেরে সব্জির বাজারে যে এতবড় বিপর্যয় নেমে আসবে তা তাঁরা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। সব্জির দাম এইভাবে দিনের পর দিন তলানিতে নামতে থাকলে বিষ পান করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।’
চাষিদের এই অবস্থা নিয়েছেন সালিমডাঙ্গার আড়তদাররাও। শেখ পিন্টু, শেখ মর্তুজ আলি প্রমুখ আড়তদাররা বলেন, ‘লকডাউনে কাঁচা সব্জি ও আনাজ সহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পরিবহনে ছাড় দিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশি ধরপাকড়ের ভয়ে বাইরের বড় পাইকেরদের কেউই গাড়ি নিয়ে সব্জি আড়তে আসছে না। আড়তে এখনও প্রতিদিন ৭০-৮০ টন সব্জির আমদানি হলেও তা কেনার লোক নেই। অর্ধেক সব্জিও বিক্রি হচ্ছে না। সে কারণে দিনের পর দিন সব্জির দাম একেবারে তলানিতে নেমে যেতে থাকায় চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। ’রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘চাষিরা যাতে আর্থিক ক্ষতির মুখে না পড়েন সেই বিষয়টি সরকার দেখবে। যে যে সব্জি আড়তে সমস্যা তৈরি হয়েছে সেগুলি নির্দিষ্ট করে চাষি স্বার্থে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’