ডিজিটাল ডেস্ক : আকাশের তারা হয়ে গিয়েছেন বহুদিন। তবুও তাঁর সিনেমা, তাঁর লেখা থেকে আজও নিত্য রসদ সংগ্রহ করি আমরা। তাঁর হাত ধরেই বাংলা বা ভারতীয় সিনেমা বিদেশে মাথা উঁচু করতে শিখেছিল। তাঁরই জন্ম শতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এ যুগের পরিচালক অনীক দত্ত(Anik Dutt) তাই বেছে নিয়েছেন তাঁকেই। স্বয়ং সত্যজিৎ রায়(Satyajit Ray) ক্যামেরার সামনে অভিনয় করবেন অনীকের ছবিতে।
অন্তত দর্শকদের তাই মনে হবে। অভিনেতা জিতু কমল-কে সত্যজিৎ রায় সাজিয়ে অর্থাৎ তাঁর মতো করে মেকআপ করিয়ে পর্দায় আনছেন অনীক।
ছবির ফার্স্ট লুক চমকে দিয়েছে দর্শকদের। জিতু কমল(Jitu Kamal)-কে দেখে প্রত্যেকেই অবাক এবং অভিভূত। এ কে? এ যে একেবারেই সত্যজিৎ রায়! প্রস্থেটিকের সাহায্যে প্রখ্যাত মেকআপ শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডু জিতুকে একেবারে মাণিকদা সাজিয়ে তৈরি করেছেন ছবি অপরাজিত(Aparajito)। যখন ছবির পোস্টার প্রকাশ্যে এল, তখন তো থ বনে যাবার অবস্থা। পোস্টারের মাথায় লেখাই আছে, অনীক দত্তর শ্রদ্ধার্ঘ্য। নীচে জিতু মানে সত্যজিৎ রায়। পাজামা আর ঢোলা পাঞ্জাবি, মুখে সিগারেট, অরিফ্লেক্স ক্যামেরার পিছনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেই চির চেনা ভঙ্গিতে, মুখে চিন্তার ছাপ। পিছনে একটি ছবি আঁকা, দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে দৌড়োচ্ছে। বোঝা যায়, এই সেই অপু-দুর্গার(Apu-Durga) প্রবাদে পরিণত হয়ে যাওয়া ছবি যখন তারা দৌড়ে কাশফুলের ভেতর দিয়ে ট্রেন(train) দেখতে যাচ্ছে, জীবনে প্রথম।
এই ছবি সত্যজিৎ রায়ের ওপর তোলা কোনও ডকুমেন্টারি(documentary) নয়। সত্যজিৎ রায়ের বায়োপিক(biopic)ও নয়। অনমনীয় জেদ, অসম্ভব আর্থিক কষ্ট– সব কিছুকে উপেক্ষা করে সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী ছবিটি করেন। ছবির পিছনের সেই ইতিহাসই উঠে আসবে অনীক দত্তের অপরাজিত-তে । এখানে সত্যজিৎ রায়ের নামকরণ করা হয়েছে অপরাজিত রায়। তাঁর নমেই ছবির নাম, অপরাজিত। অপরাজিত রায় যে ছবি করছেন তার নাম পথের পদাবলি। ছবি নিয়ে অনীক বলেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে সেই প্রতিভা, সেই আত্মবিশ্বাস এবং সেই সাহস ছিল, যা দিয়ে তিনি নিজের স্বপ্ন সত্যি করতে পারতেন। পেরেওছিলেন। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর জন্ম শতবর্ষে আমি এই ছবি বানিয়েছি। সঠিক অর্থেই অপরাজিত প্রেরণা দেবার ছবি। কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয় এবং কীভাবে তা পূরণ করতে হয়, তার রসদ পাওয়া যাবে এই ছবিতে।
জিতু কমল অভিনয় করেন, এ খবর অনীক দত্তের কাছে ছিল না। একবার তিনি এক জমায়েতে দেখেন জিতুকে। তখনই খটকাটা লাগে এবং মনে হয়, এ-ই সে, ঠিকঠাক চেষ্টা করলে, তৈরি করলে এ হয়ে উঠতে পারে তাঁর ছবির অপরাজিত বা সত্যজিৎ। আগে আবীর চট্টোপাধ্যায় (Abir Chatterjee) ঠিক করা হয়েছিল এই চরিত্রে, পরে ডেটের কারণে আবীর ছবি থকে বেরিয়ে যান। তারপর যোগাযোগ করা হয় জিতুর সঙ্গে। মেকআপ-এর পর ওর লুক টেস্ট সবাইকে চমকে দিয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে শারীরিকভাবে এত মিল! এরপর জিতুই হয়ে যান সত্যজিৎ।
সাধারণ চরিত্রে অভিনয় আর ক্যামেরার সামনে সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠা, দুটো আলাদা। তাই এই ছবির সময়ে জিতু পরিশ্রম, ধৈর্য, আত্মত্যাগ, মনঃসংযোগ ইত্যাদিকে নিয়ে যুদ্ধটা করতে নামেন, সঙ্গে অবশ্যই ছিল পরিচালকের হাত। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠা, ২-৩ কাপ চা খাওয়া, মাণিকদার মতো করেই হাঁটা, কথা বলা, তাকানো, সব নিয়ম করে করতেন এবং সেটা জিতু কমলকে ভুলে গিয়েই। এমনকি বাড়িতে জোরে শব্দ হলেও বলতেন, শব্দ না করে রান্না করতে না পারলে এ বাড়িতে রান্না করা বন্ধ করে দাও। এ কথা তাঁর অভিনেত্রী স্ত্রী নবনীতা দাস বলেছেন। এভাবেই ক্যামেরার সামনে সত্যজিৎ রায় হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছেন জিতু। অপরাজিত-তে সত্যজিৎ-পত্নী বিজয়া রায়ের চরিত্রটি করছেন সায়নী ঘোষ। তাঁর নাম হয়েছে বিমলা রায়। এখানেও মেকআপ শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডুর হাতযশ আছে, যার কল্যাণে সোহিনী হয়ে উঠেছেন বিমলা বা বিজয়া।
সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী-র চেনা এবং কিংবদন্তি কিছু ফ্রেম যেমন ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুদৃশ্য, অপু-দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজা, তাদের ট্রেন দেখতে যাওয়া ইত্যাদি অনীকের অপরাজিত- তে এসেছে। বীরভূমে, কলকাতার নন্দনে, শিশির মঞ্চে শুটিং করেছেন অনীক দত্ত।
১৯৫৬ সালে কান ফিলম ফেস্টিভ্যালে(Cannes Film Festival) পথের পাঁচালী সেরা হিউম্যান ডকুমেন্টের অ্যাওয়ার্ড(best human document Award) পায়। এখান থেকেই জন্ম হয় আন্তর্জাতিক মানের বাংলা ছবির।
এখান থেকেই জন্ম হয় সত্যজিৎ রায়ের।
২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুদিনে রইল তারাদের কথা-র শ্রদ্ধার্ঘ্য।
আরও পড়ুন : অনির্বাণ-ইন্দ্রনীল-টোটা কে হবে সন্দীপ রায়ের ‘ফেলুদা’?