মহম্মদ আশরাফুল, চাকুলিয়া : ছোটবেলায় বাবার অকালমৃত্যু। নিত্য অনটন সঙ্গী করে চলছিল পড়াশোনা। তারমধ্যেই আবার দুর্ঘটনায় এক বছরের জন্য শয্যাশায়ী। এত বাধাকে জয় করে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি এন্ট্রান্স টেস্টে প্রথম স্থান দখল করে নজির গড়লেন চাকুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে শহরবানু খাতুন। তবে তাঁর লড়াই এখনও শেষ হয়নি। গবেষণার জন্য বিপুল টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে চিন্তায় শহরবানু। তবে শত বাধাবিপত্তি টপকেও শহরবানুর কৃতিত্বে খুশি তাঁর মা-দিদি ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
চাকুলিয়ার বিহেরিয়া গ্রামে একচিলতে জমিতে বাড়ি শহরবানুর। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট তিনি। এক দাদা শাকিল আখতার দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগে ভুগছেন। আরেক দাদা অন্যত্র থাকেন। বৃদ্ধা মা সেলিনা বেওয়া ও দিদি ফারজেনা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে থাকেন শহরবানু। তিনি যখন চাকুলিয়া হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, তাঁর বাবা মহম্মদ সলিমুদ্দিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন থেকে শুরু হয় শহরবানুর সংগ্রাম। তাঁর কথায়, ‘বাবা সবসময় আমায় পড়াশোনার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। বাবা যখন মারা যান, তখন মনে হয়েছিল সব শেষ হয়ে গেল। অভাবে কিছুদিনের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরে দিদি আমার পাশে দাঁড়ায়, তারপর ফের পড়াশোনা শুরু করি।’ বোনের জন্য ফারজেনা শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। মুরগি, গোরু-ছাগল পালন করে বোনের পড়াশোনা সহ সংসারের খরচ জোগাতে থাকেন ফারজেনা। চাকুলিয়া হাইস্কুল থেকে ২০১০ সালে ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেন শহরবানু। টাকার অভাবে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ি থেকে ১২ কিমি দূরে কানকি শ্রীজৈন বিদ্যামন্দির উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কলাবিভাগে ভর্তি হন শহরবানু। সব যখন ঠিকঠাক চলছে, তখন আবার বাধা। ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় নযানজুলিতে উলটে যায় যন্ত্রচালিত ভ্যান। তার নীচে চাপা পড়েন শহরবানু। ইঞ্জিনের ভিতরে থাকা গরম জলে শহরবানুর শরীরের ৬০ শতাংশ ঝলসে যায়। দগ্ধ শরীর নিয়ে টানা এক বছর হাসপাতালে কাটান তিনি। শহরবানু বলেন, ‘একটা সময় মনে হয়েছিল বাঁচব না। যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। দগ্ধ শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করেছিল। সেই সময় চাকুলিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক রফিকুল স্যার আমার পাশে দাঁড়ান। অন্য শিক্ষকরাও সাহায্য করেন। হাসপাতালে রফিকুল স্যারের এক চিকিৎসক বন্ধু ছিলেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমি আবার সুস্থ হয়েছি।’ অসুস্থ অবস্থাতেই ২০১২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে ৭৫ শতাংশ নম্বর পান শহরবানু। এরপর ২০১৫ সালে ইসলামপুর কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও ২০১৭ সালে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন শহরবানু। তারপর রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি এন্ট্রান্স টেস্টে প্রথম স্থান।
নিজের জীবনসংগ্রামের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন শহরবানু। তিনি বলেন, ‘আজ বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে বড়ো খুশি হতেন। তবে আমার মা-দিদি ও শিক্ষকরা ভীষণ খুশি হয়েছেন।’ গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় দুলাল চক্রবর্তীর বাড়িতে থাকতেন শহরবানু। তাঁর কথায়, ‘বিপদের সময় আমাকে সাহায্য করেছেন দুলাল কাকা। পরীক্ষার ফলের কথা তাঁকে জানিয়েছি। তিনিও খুশি হয়েছেন।’ তাঁর দিদি ফারজেনা খাতুন বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর মানসিকভাবে আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম। আমার স্বামী ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করেন। তিনিও সহযোগিতা করেন। বোন এই জায়গায় আসতে পারায় আমাদের ভালো লাগছে।’ চাকুলিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বাসুদেব দে বলেন, শহরবানু ছোট বেলা থেকে মেধাবী ছাত্রী। কিন্তু পড়াশোনার পরিবেশ তাঁর পক্ষে সবসময় অনুকূল ছিল না। তা সত্ত্বেও প্রতিকূলতা জয় করে সকলের নজর কেড়েছেন। আমরাও এর জন্য গর্বিত।’ চাকুলিয়ার বিডিও কানহাইয়াকুমার রায় বলেন, ‘আমি নিজে ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করছি। তাঁকে সংবর্ধনা সহ আর্থিক সহযোগিতা করা যায় কিনা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি।’