যশোধরা রায়চৌধুরী : ২৪ জানুয়ারি বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি এক বালিকা নিগ্রহের ব্যাপারে পকসো আইনের অন্যতম ধারা প্রয়োগ করতে গেলেন জনৈক বয়স্ক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। প্রশ্ন তুললেন, জামাকাপড়ের ওপর থেকে যৌন নিগ্রহ হয় নাকি? বরং দেওয়া যাক ওটাকে নারী অবমাননার তকমা। তাতে যা শাস্তি তা সহনীয়।
পকসোর কড়া শাস্তি, তিন বছরের জেল। কেন বাপু। এই যে ত্বকের সঙ্গে ত্বকের সংযোগ হল না, পেয়ারা খাওয়াবার লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে বাচ্চাটাকে জামাকাপড় পরা অবস্থায় বুক ছোঁয়া হল, এতে তো শাস্ত্রমতে যৌন নিগ্রহ হচ্ছে না বাপু।
দেশ জোড়া তুমুল প্রতিবাদ, প্রায় ঝড় বয়ে গেল আমাদের মতো অনেকের মনে। এই রায়টা কতটাই অর্থহীন, তা বলে দেয় শিশি-বোতল বা লোহার রড প্রবেশ করিয়ে ভয়াবহতম ধর্ষণের ইতিহাস আমাদের দেশেই। ত্বকের সংগে ত্বকের সংযোগ? হাস্যকর!!! জামাকাপড়ের বাইরে থেকে কীভাবে দলিত অবমানিত হয়েছে আমাদের শিশুশরীর, কতবার! নিজের দোষ ভেবে আমরা চুপ করেও থেকেছি, বাবা-মাকে বলতে পারিনি?
আমরা, যারা শিশুবয়স থেকে জানি, কাকে বলে যৌন নিগ্রহ। এ মোর দুর্ভাগা দেশ, পাঁচ, ছয়, সাত বছরের অবুঝ বয়সে জেনেছিলাম বাড়িতে কাজের লোক বা দূরসম্পর্কের আত্মীয়-কুটুমের নোংরা স্পর্শ অথবা বাসে-ট্রামে, সিনেমাহলে, বারোয়ারি পুজোয় রাস্তায় বা রবীন্দ্র সদনের টয়লেটের কাছটায় অযাচিত নোংরা স্পর্শ, পুরুষের। শেষমেশ ওই রায় স্থগিত সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে। আর তার দিনকয়েক পরেই, ৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্র খুলে নির্মম কাহিনী সবিস্তারে পড়তে পারলাম না। চা-বিস্কুট উঠে আসছিল।
কলকাতার জোড়াবাগানে মামার বাড়িতে বেড়াতে আসা এক নয় বছরের বালিকার বিবস্ত্র নিথর দেহ পাওয়া যায় ছাতের সিঁড়িতে। অতি অবশ্যই, যৌন নির্যাতনের পরে খুন। কেননা সে জানত না, অল্প চেনা পুরুষের কী থাকে চাওয়ার, ছাতের সিঁড়িতে নিয়ে যায় যে জন্য। প্রতিবাদ করলে, চেঁচিয়ে উঠলে, কাঁদলে প্রাপ্য হয় গলা টিপে বা পিটিয়ে মৃত্যু। সেদিনই ছত্তিশগড়ে পেলাম আরেক খুনের গল্প। একই কাহিনীর এদিক-ওদিক। মেয়েটিকে ধর্ষণ করে তাকে ও তার আত্মীয়দের মেরে ফেলার গল্প।
হ্যাঁ, এখন সব গল্পকথাই।
বছর কয়েক আগের কথা। নতুন বছরের উল্লাস এবং সিজন্স গ্রিটিংস-এর হুল্লোড়, রংবেরংয়ে কার্ড আর সাজসরঞ্জাম, বেলুন আর ফিতের দুনিয়ায় একটা ছোট্ট মেয়ে ফ্রকে রক্তের দাগ লাগল। জ্বরের ঘোরে, ট্রমায়, ভয়ে থরথর কাঁপনে সে মেয়ে ঢুকে গেল এক অন্ধকারের দিনকালে।
আরও আগে কীর্তন গায়ক নরপিশাচ বিকৃতরুচি সনাতন ঠাকুর এক আড়াই বছরের শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন শুধু চালায়নি, তার শরীরে সাতটি বড় সুচ বিঁধিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন। সেই শিশুর মৃত্যুর আগে-পরে সামাজিক মাধ্যমের প্রতিক্রিয়ার কথাটা মনে পড়ছে আজ। কিন্তু সেদিনের সে ঘটনা ইতিমধ্যেই মাথা থেকে ঝরে পড়ে গিয়েছে সীমিত স্মৃতির জনগণের। এমনকি তারও আগে সেই বারো সালের ডিসেম্বরের আরও এক ভয়াবহ ধর্ষণ কাণ্ডের স্মৃতি ও পরবর্তী প্রতিবাদ-চিৎকারের স্মৃতিও পানসে। নির্ভয়ার পরে আরও কত কত মেয়েকে যে ধর্ষিত হয়ে খুন হতে হয়েছে, গোনাগুনতি নেই।
কোনওটাই আসলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিসংখ্যান বলছে সারা ভারতের ৫৩ শতাংশ শিশু, কোনও না কোনওভাবে নির্যাতনের শিকার। আর শুধু কন্যাশিশু নয়। বালিকাদের প্রায় সমান সংখ্যক বালকও নির্যাতিত হয় কখনও না কখনও। শিশুরা কতটা আদৌ সংরক্ষিত স্কুলের মতো একটা চৌহদ্দিতে, সে প্রশ্নও তো উঠেছে কিছুদিন আগে হরিয়ানায়, গুরুগ্রামের রায়ান পাবলিক স্কুলে এক বালকের খুনের ঘটনায়।
প্রতিবারই সমাজমাধ্যমে এসব ঘটনা ঢেউ তোলে। নারীরা চিৎকার করেন, অনেক পুরুষ হ্যাঁ-তে হ্যাঁ দেন। আবার চুপ করেও থাকেন। লজ্জা পান কেউ। কেউ বিরোধিতা অনুভব করেন। সব পুরুষ এমন নয়। অনেকে আবার প্রাকৃতিক নিয়মের প্রশ্ন তুলে যে কোনও ধর্ষণকে মান্যতাও দিতে চেষ্টা করেছেন দেখেছি। হায় রে! গান, কবিতা, বিতর্ক দোষারোপ শাপশাপান্তের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে একটা সত্য। আমাদের সমাজে এ ঘটনা নতুন নয়, এ ঘটনা চারিদিকে চোখ মেললেই দেখা যাবে। বহুধাবিভক্ত ভাবনাচিন্তার সূত্র। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার পথ একবার উন্মুক্ত হয়ে গেলে, তীব্র এবং চূড়ান্ত কিছু কথা বলে ফেলতে পারলে যে তড়িৎমোক্ষণ ঘটে, তাতে সাময়িক শান্তি পাই আমরা পাবলিক নামাঙ্কিতরা। দীর্ঘস্থায়ী কোনও কাজ তাতে হয় কি?
সত্যি করে কিছু ধরাছোঁয়ার মতো সমাধান কি নেই আদৌ? ভাবতে পারি না আমরা এই নীচে লিখে দেওয়া দাবিগুলো তুলে ধরার কথা? সবাইকে জনে জনে বিজ্ঞাপিত করে জানানো হোক, পকসোর কথা। যা আমরা অনেকেই জানি না। এই তো ২০১২ সালেই আইনে পরিণত হয়েছে পকসো- প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস। আইনটি নতুন বলেই এখনও অনেকের জানা পর্যন্ত নেই এই আইনের পরিধি ও প্রয়োগ। অথচ এ আইন আনাই হয়েছিল আগেকার ভারতীয় দণ্ডবিধির কিছু সীমাবদ্ধতাকে মাথায় রেখে।
একটা সীমাবদ্ধতা অবশ্যই ছিল এই যে দণ্ডবিধির যেসব ধারায় বিচার চাওয়া যেত, সেগুলো বেশিরভাগই শিশুকন্যাদের জন্য প্রযোজ্য এবং চিরাচরিত ধর্ষণের সংজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত। নতুন আইনে, শিশুপুত্রদেরও অত্যাচারিত শিশুর আওতায় আনা হয়েছে আর যৌন নির্যাতনের সংজ্ঞার আওতায় নানা ধরনের বিকৃতকাম ব্যবহারকে আনা হয়েছে। পকসোর নাগালে যে কোনও অভিযোগের বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হোক। যাতে মানুষ রিপোর্ট করতে ভয় না পান, মানুষ এগিয়ে আসেন বিচার চাইতে।
যেমন আমার ছোটবেলায় যেসব নির্যাতন চলে যেত ফিশফিশ করে বলা নিষিদ্ধ গসিপের আওতায়, আজ তা সর্বসমক্ষে আনছেন শিশুদের (কন্যা বা পুত্র) বাবা-মায়েরাই। এটা একটা সদর্থক দিক। অনেকেই বলছেন, এই তো! যত বেশি আইন হচ্ছে ততই বাড়ছে অপরাধও! এটা ভুল। আসলে আমার তো মনে হয়, অপরাধ বাড়ছে না। আগেও এইসব অপরাধ সংঘটিত হয়ে চলত। আজ, অপরাধগুলো সামনে আসছে মাত্র।
আশৈশবের অভিজ্ঞতায় কত যে ঘটনা মনে পড়ে যায়, যেখানে কোনও না কোনও শিশুকে দেখেছি মারাত্মকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে। আমাদের দেশের কথা এ নয়, সারা পৃথিবীতে পিডোফিলিয়া নামক মানসিক বিকারের অজস্র নিদর্শন তো আছে। বিকৃতকাম কিছু মানুষের কাছে নরম, রোমহীন, কচি মাংসগুলি বেশি আকর্ষক এবং সে আকর্ষণের কিছু সাহিত্যিক বা নান্দনিক মান্যতা নিয়ে একদা প্রশ্ন উঠেছিল বহুচর্চিত সে সব নিষিদ্ধ বইয়ের ভ্লাদিমির নবোকভের লেখা লোলিটার মতো সাহিত্য অথবা কিছু বিদেশি ছায়াছবির কথা মনেই পড়ে যায়। কিছু সাহিত্যগুণ বাদ দিলে, এই প্রবণতা আজ আমাদের কাছে অপরাধ বলেই বিচার্য হবে নিঃসন্দেহে।
য়ে আক্রান্ত চলে গেল, সে তো বাবা-মার বুক খালি করে গেল। যে বেঁচে গেল তার মানসিক ক্ষতির কথাও ভাবুন বিচারকরা। আক্রামক পুরুষটির শাস্তি কমানোর কথাটা না হয় পরে ভাববেন।
(লেখিকা কলকাতার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক)