শমিদীপ দত্ত শিলিগুড়ি : অকালে মৃত্যু হয়েছিল স্বামীর। মৃত্যুর শোকটুকু করার সময় পাননি শিপ্রাদেবী। কোমর বেঁধে নামতে হয়েছিল স্বামীর বরাত পাওয়া প্যান্ডেলের কাজ শেষ করার জন্য। এক ছেলেকে নিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সূর্য সেন কলোনির এ ব্লকের বাসিন্দা শিপ্রা মজুমদার সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলেন স্বামীর এই পেশাকেই তিনি হাতিয়ার করে বাঁচবেন। কিন্তু পথ ততটা মসৃণ ছিল না। অনেক অবজ্ঞা, বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে। সেই যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে কিছু মানুষের ভরসার জোরে তিনি এখন রীতিমতো অন্য ডেকোরেটারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহরে কাজ করছেন। বিভিন্ন পুজো কমিটি থেকে রাজনৈতিক দল- প্যান্ডেল তৈরির মাধ্যমে দখল করে নিয়েছেন আলাদা জায়গা।
শিপ্রাদেবীর স্বামী স্বপন মজুমদার প্রথম থেকে ডেকোরেশনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে হঠাত্ করে মজুমদার পরিবারে ঝড় নেমে আসে। স্বপনবাবুর আকস্মিক প্রয়াণে শিপ্রাদেবীর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। কোনোভাবে বরাত পাওয়া কাজগুলি শেষ করার পর প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেয় ভবিষ্যত্ নিয়ে। ছেলেকে নিয়ে শিপ্রাদেবী স্বামীর এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই কাজে তো ঘুরে ঘুরে বরাত নিতে হবে। কর্মীদের দিয়ে কাজ করানো য়ে সহজ নয়। স্বভাবতই শিপ্রাদেবী বরাতের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলেও উত্তর আসে না। শিপ্রাদেবী জানান, বিশ্বকর্মার পুজোর জন্য সিকিম ন্যাশনালাইজড ট্রান্সপোর্ট (এসএনটি) অফিসে প্যান্ডেলের বরাত চাইতে গেলে তিরস্কারের শিকার হতে হয়েছিল। এমনকি ঘরভাড়া দিতে না পারায় ছেলেকে নিয়ে বাড়িও ছাড়তে হয়। সবকিছু হারানোর মাঝেই সে বছর দুর্গাপুজোয় ইসকন রোডের একটি পুজো কমিটির বরাত শিপ্রাদেবীর মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার ঘটায়। পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে কালিম্পংয়ে থোঙসা গুম্ফার অনুষ্ঠানে প্যান্ডেল তৈরির বরাতটাই জীবনের মাইলস্টোন বলে মনে করেন শিপ্রাদেবী। ইতিমধ্যেই দুর্গাপুজো, কালীপুজোয় মাল্লাগুড়ি অ্যাথলেটিক ক্লাব, জুয়েল ক্লাব, শোভা বয়েজ ক্লাব, নিউ টেনিস ক্লাব থেকে শুরু করে কিশোর সংঘের কর্মকর্তাদের আস্থা জিতে পুজোমণ্ডপ করেছেন। এমনকি ২০১৫ সালে ছটপুজোয় তাঁর তৈরি সোনাপট্টির ঘাটের মণ্ডপ পুরস্কারও পায়। গত লোকসভা ভোটে কাওয়াখালিতে আয়োজিত মোদির সভাতেও তিনি কিছু কাজ পান। এমনকি ড্রপ গেট তৈরির সময়ে তদারকি করতে গিয়ে বাইক দুর্ঘটনায় পা ভাঙে শিপ্রাদেবীর। যদিও ভাঙা পা নিয়ে কিশোর সংঘ ও শোভা বয়েজ ক্লাবের দুর্গাপুজোর মণ্ডপের তদারকি করতে তিনি নেমে পড়েছেন। শিপ্রাদেবীর কথায়, অনেকেই আমাকে বিশ্বাস করেননি। অবজ্ঞা, কটক্তিও শুনেছি। তবে অন্যদিকে বহু মানুষের কাছে ভরসাও কিন্তু আমি পেয়েছি। সেই ভরসার জোরে ছেলেকে নিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি। অ্যাসোসিয়েশনও আমাকে সবসময়ে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছে।
ডেকোরেটার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ নর্থবেঙ্গলের দার্জিলিং জেলা কমিটির সম্পাদক গোপাল সরকার বলেন, শিপ্রাদেবী একজন মহিলা হয়ে যেভাবে এই কাজ করে চলেছেন সেটা আমাদের সকলের কাছে একটা দৃষ্টান্ত। মহিলারাও যে এই কাজ করতে পারেন সেটা শিপ্রাদেবী সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।