শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা : দিনমজুরি করে কুড়ি বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন আস্ত একটি বাগান। শাল, সেগুন থেকে নাসপাতি, আঙুর, বোগেনভেলিয়া কিংবা নাইট কুইন- কী নেই সেখানে! রয়েছে নানা ঔষধি গাছও। এই বাগানের ফুল-ফল ছেঁড়া যায় না। কারণ ওসব শুধু হাজারো জানা-অজানা পাখপাখালি আর রং-বেরঙের প্রজাপতিদের জন্য। বাগানের মালিক নাগরাকাটার সুখলাল কিন্ডো নামে বছর পঞ্চাশের এক ব্যক্তি। সুখলাল যেন প্রকৃত অর্থেই সেই কালজয়ী সিনেমা বাঞ্ছারামের বাগান -এর বাঞ্ছারাম। যিনি নিজের সন্তানসম গাছগাছালির জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত।
নাগরাকাটার উপকণ্ঠে ৩১সি জাতীয় সড়কের ধারে যেখানে নবোদয় বিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরির কাজ চলছে তার পাশেই সুখলালের বাগান। জমির আল কিংবা মেঠো রাস্তা ধরে সেখানে পৌঁছাতে হয়। ২০০১ সাল থেকে প্রায় ৬ বিঘা জমির ওপর ওই বাগান গড়ার কাজে হাত দেন। একচিলতে জমির ওপর কুঁড়েঘর তৈরি করে থাকেনও সেখানে। প্রতিদিন ভোর হলেই শুরু হয় কয়েকশো প্রজাতির গাছগাছালির পরিচর্যার কাজ। এরপর চলে যান দিনমজুরি করতে। যা আয় হয় তা দিয়ে শুধু একার পেটই চলে না, ক্রমশ বাড়তে থাকে তাঁর সবুজ বন্ধুদের সদস্যসংখ্যাও। আয়ে প্রায় পুরোটাই খরচ করে দেন গাছের জন্য।
বাগানে ঠিক কী কী ফুল, ফল কিংবা অন্য গাছ রয়েছে তা ঘুরে দেখতে অন্তত কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। শীতে সেখানে ঝুলে থাকে থরেথরে কমলা। আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, আঙুর, বেদানা, আনারস, আখ, সবেদা, শিমলা কুল, লটকার মতো আরও হাজারো ফলের গাছের সম্ভার তো রয়েছে। সারা বছরই শোভা পায় অজস্র বাহারি ফুল। পাইন, দেবদারু, ঝাউ, মানি প্ল্যান্ট, গামারি, শাল, সেগুন, চাপ, চিকরাশি, কালোমেঘ, সজনে, তেজপাতা, রুদ্রাক্ষর মতো আরও অজস্র গাছ সেখানে এখন মাথা তুলে যৌবনের দোরগোড়ায়। শাকসবজিও পিছিয়ে নেই। এককথায় পরিচিত গাছ তো রয়েছে। যা সচরাচর দেখা যায় না সেসবও এখন পরম যত্নে বাড়ছে ওই পারিজাতে।
আদতে ভগৎপুর চা বাগানের বাসিন্দা সুখলালের বাগানবাড়ির কুঁড়েঘরেরও সর্বত্র শিল্পের ছোঁয়া। একটা গাছও কাউকে স্পর্শ করতে দেন না সুখলাল। বলছেন, কবে থেকে যে ওরাই আমার ছেলেমেয়ে হয়ে উঠেছে বুঝতেই পারি না। কাজে যাওয়া ছাড়া বাকি সময় গাছেদের সঙ্গেই থাকি। কত পাখি যে এখানে ঘাঁটি গাড়ে সব কটার নামও জানি না। সব ফল ওদের জন্যই আর ফুল প্রজাপতি-মৌমাছিদের। অকৃতদার মধ্য পঞ্চাশের সুখলালের আক্ষেপ, এখানে জলের বড় কষ্ট। ফলে গাছে প্রয়োজনীয় সেচ দেওয়া যায় না। অনেকেই বেড়াতে আসেন। নেই শৌচালয়ও।
য়ে রুক্ষ-শুষ্ক জমির ওপর এমন রূপসী বাগান সেটা ইংরেজ আমল থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষের দখলে থাকলেও পাট্টা মেলেনি, যা যন্ত্রণা দেয় গাছপাগল মানুষটিকে। ভালোবেসে বাগানের এই নাম দিয়েছেন প্রকৃতি পার্ক। নিজের হাতে লিখে ঝুলিয়েছেন সাইনবোর্ডও। তাঁর নামেই গোটা তল্লাটের নাম হয়েছে সুখলাল বস্তি। সেখানেই থাকেন তাঁর দাদা বলিরাম কিন্ডো ও মামা গঙ্গা ওরাওঁ। সময় পেলেই ওই পার্কে ঢুঁ মেরে আসেন সুলকাপাড়ার মকলেশ রহমান কিংবা কৃষ্ণা ওরাওঁ-এর মতো যুবকরা। তাঁরা বলেন, খুব কম লোকই এমন বাগানের কথা জানে। এখানে দুদণ্ড কাটালেই মনটা ভালো হয়ে যায়। তাই বারবার আসি।
এমন মানুষও এলাকায় রয়েছেন তা জানাই ছিল না ব্লক প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের। নাগরাকাটার বিডিও বিপুলকুমার মণ্ডলের কথায়, বিশ্বাসই হচ্ছে না। সুখলাল যদি আমাদের কাছে আসেন তবে ওর প্রযোজনীয়তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে।