মহুয়া চট্টোপাধ্যায়, শিলিগুড়ি: এবছরের মতো অম্বুবাচী তিথি আজ শেষ হবে রাত ৮ টা ১৯ মিনিটে, কালকে শোধন ও সংস্কারের পর আবার নিত্যপূজা শুরু হবে। দেবীদের এই ঋতুমতী হবার ব্যাপারটা এতো ফলাও করে প্রচার ও পালন করার কি প্রয়োজন? রজঃস্বলা হওয়ার ব্যাপারটা যদি এতটাই ছিছিক্কারের ব্যাপার মানবীদের ক্ষেত্রে, তাহলে দেবীদের এই সময়ের রক্তরঞ্জিত বস্ত্রখন্ড কেন এতটাই পবিত্র যে পুরুষেরা বা পুরোহিতেরা তা নেবার জন্য কাড়াকাড়ি করেন? বাড়িতে ঈশ্বর আরাধনার আসনে সেই বস্ত্রখন্ডটি প্রতিস্থাপিত করে কেন সুখ-সৌভাগ্যের স্বপ্ন দেখেন? আর স্ত্রী- কন্যারা ঋতুমতী হলে তাদের খানিকটা ঘেন্না করেন, আবার তাদের কাছ থেকেই সন্তানকামনা করেন, উত্তরাধিকারের ইচ্ছে পোষণ করেন! বহুবছরের কিছু জমা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের এই লেখা।
সভ্যতার প্রথম দিকে যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল তা এখনকার ছোট বাচ্চারাও জানে। আর তারা এটাও জানে মা হবার জন্য যে একবছর মহিলারা ঘরের ভেতর ঢুকে গেল সেটা উপর্যুপরি চলতে থাকল, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নারী সংসার-সমাজ-সন্তানে আটকে গেল বৈদিক থেকে বর্তমান কালে। মেধা-মননের জীবন থেকে অবতরণ করানো হল মৈথুনপুতুল রূপে। জ্ঞানের গরিমায় নয় সৌন্দর্যের আত্মম্ভরিতার মিথ্যেজালে তাদের আটকে দিল বলশালী পুরুষ সমাজ। নারীর প্রতি মাসের রক্তক্ষরণ জাতি সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত- নিবেদিত; কিন্তু এই অসমসাহসী কাজকে ঘুরিয়ে ‘পাপ-পূণ্যের’ ও নিকৃষ্টতম ঘটনার চাদরে মুড়িয়ে এমন ভাবে ঝড় তুলে দিল সমাজ যে ধীরে ধীরে নিস্ক্রিয় হওয়া শুরু করল নারীরা। সন্তানধারণ ও পালনে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়লে সুকৌশলী পুরুষ সেই আসন কব্জা করতে শুরু করলো। অনভ্যাসে নারী ভুলল তার শিক্ষা,উদ্যেশ্য,পরিচয়। সমাজ ও মানবজীবন আজ মঙ্গলগ্ৰহ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেও নারীজীবনের পিরিয়ড নিয়ে আজও সে খানিকটা পিছিয়ে, আমরাও তাই, অথচ অম্বুবাচী বা রজউৎসব কিন্তু হৈহৈ করে পালনীয় আমাদের জীবনে। এই কূপমন্ডুক মানসিকতাকে ভাঙা আমাদের আশু কর্তব্য। মনে রাখতে হবে নারীরাই সৃষ্টির ধারক-বাহক। তারা না থাকলে উর্বর পুরুষ বীর্য কিন্তু মাটিতে সন্তান ফলাতে পারবেনা। এই অম্বুবাচীতে আমরা ভগবানকে নিবেদন করছি আম-দুধ, অর্থাৎ রক্তক্ষরণের ফলে যে শক্তিক্ষয় তাকে পূরণ করতে আমের কার্বোহাইড্রেট -প্রোটিন-ফাইবারের সঙ্গে দুধের ক্যালসিয়াম ও ফ্যাট দেবীদেহে যোগান দেবে সুষম আহার। যাঁরা এই তিথি পালন করেন প্রসাদ হিসেবে এই খাবার খেলে তাদের ও শক্তির যোগান হয়। তাহলে প্রতিমাসের রক্তক্ষরণে নারীরা কি এতটুকুও যত্নের আশা করতে পারেনা? পারে, সেই জন্যই প্রথম তিনদিন তাদের রান্নাঘরে ঢুকতে বারণ করা হয়।হালকা কাজ করতে বলা হয় এটা ডাক্তারী মত। সেই মতকে আমরা ভেঙেচুরে নিয়েছি এই বলে যে নারীরা অশুচি, তাদের হাতে কেউ খাবেনা। স্বামীর আয়ুক্ষয় হবে তাই ঐ দিনগুলোতে তারা অন্যঘরে মাটিতে শোবেন, নিদান আছে এমনটাই। আসল ঘটনা আগেকার দিনে মনোরঞ্জন হিসেবে সহবাসকে দেখা হত, এখনকার মতো এত মনমোহনকারী উপাদান ছিলোনা। পিরিয়ড চলাকালীন সহবাসে ইনফেকশন থেকে প্রাণঘাতী যৌনরোগের সৃষ্টি হত তাই নিয়মের নিগড়ে সংস্কারে বেঁধে দিয়েছিলেন সমাজের কর্তারা। মনে রাখুন এই সময় হলকর্ষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারণ প্রচুর বৃষ্টিপাতে মাটি এখন রসপূর্ণ হয় যা ভবিষ্যৎ ভালো ফসল পাবার একমাত্র রাস্তা। কিন্তু দেখুন কালের নিয়মে তা হয়ে দাঁড়ায় কু-সংস্কার যার আগামাথা নিয়ে ভাবার এবং ব্যাখ্যা করার মানুষ গেল কমে। গুরুজনদের সামনে আসা যাবেনা এই সময়ে তার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায় তখনকার দিনে স্যানিটারী ন্যাপকিনের বা অন্তর্বাসের দূরদূরান্তে কোনও খোঁজ ছিলোনা নরম সুতির কাপড় তাঁরা ব্যবহার করতেন কিভাবে কে জানে! তাই গুরুজনদের সামনে আসা যেতনা। এই প্রসঙ্গে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পর্ব স্মরণীয়, যেখানে ব্যাসদেব তাঁকে ‘একবস্ত্রা রজঃস্বলা নারী’ হিসেবে দেখিয়েছেন। আজ আমাদের জীবনে এই মিথগুলো খাটেনা ঠিকই কারণ এখন বহু উপায় ও উপাদান আছে, বৃহৎ সংসার ক্ষুদ্র হয়েছে, পেশা থেকে নেশা সর্বত্রই এখন নারীরা চলমান, বহু ধর্মগুরুরা পিরিয়ড চলাকালীন পুজোয় কোনো বাধা নেই বলছেন, তবুও আমাদের মন যেন সায় দেয়না। এইখানেই আমাদের ব্যর্থতা। নিতান্তই জীবনযাপনের অংশ হিসেবে আমরা কেন দেখিনা এই শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে? কেন আমার পুত্র সন্তানটিকে এর যথার্থ ব্যাখ্যায় সমৃদ্ধ করিনা যাতে সে তার সহপাঠী মেয়েটিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে কোনও নোংরা কথা বা ভাষা প্রয়োগ না করেই? কেন আমার কন্যাকে আমি তার এই শারীরিক নিয়মের ব্যাখ্যা সঠিক ভাবে দিয়ে শিক্ষিত করে তুলিনা? কেন এত রাখঢাক মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অংশে? সঠিক যৌনশিক্ষায় আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষিত করতে পারি কিন্তু আমরাই। কারণ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ওরাই, ফলে প্রতিটি ব্যাখ্যা সঠিকভাবে দিলে ওরা বুঝবে। আমার-আপনার চেয়ে ওরা অনেক এগিয়ে মানসিক দৃঢ়তায়। চিন্তা-যত্ন-ব্যাখ্যার সু-সংমিশ্রণে পিরিয়ড নিয়ে আগামী দিনে আর কোনো নারীকে যেন বিব্রত না হতে হয় তার শপথ নেবার দিন কিন্তু আজই। এবছরের অম্বুবাচীর শেষ দিনে।
আরও পড়ুন : রাত জাগার ফলে শরীরে যে সব রোগের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে