শুভঙ্কর চক্রবর্তী ও তমালিকা দে, শিলিগুড়ি : কাচের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই স্যর, স্যর বলে ছুটে এলেন স্যুট-কোট পরা এক ব্যক্তি। দরজা খুলে বসালেন ‘ভিআইপি চেম্বার’ এ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চলে এল ঠান্ডা জলের বোতল। ঢোক গেলার আগেই ল্যাপটপ হাতে হাজির হলেন ‘ম্যারেজ এগজিকিউটিভ’। শিলিগুড়ির সেবক রোডের ঝাঁ চকচকে ওই কর্পোরেট অফিসে পাত্র খুঁজতে এসেই প্রতারণার ফাঁদে পড়েছিলেন ইসলামপুরের পারমিতা ভদ্র।
না, শুধু পারমিতা নন, প্রতারিতদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। পাত্রপাত্রী খোঁজার নামে ‘ম্যাট্রিমনি অফিস’-এর আড়ালে লোক ঠকানোর কারবার চলছে কয়েক বছর ধরেই। ইতিমধ্যেই মোটা টাকা খুইয়েছেন অনেকেই। শিলিগুড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্রে পুলিশ, গোয়েন্দা, পুরনিগম সবার নজর এড়িয়ে কীভাবে কারবার চলছে তা নিয়েও রহস্য। তবে তার থেকেও বেশি রহস্যময় বর-বৌ খুঁজে দেওয়ার পদ্ধতি।
পাড়ার ঘটক আর ওই অফিসের ম্যাট্রিমনি অফিসের ‘ম্যারেজ এগজিকিউটিভ’-এর কাজ মোটামুটি একই। পাত্র আর পাত্রী খুঁজে বের করে, দুই পরিবারের আলাপ করিয়ে বিয়ে ঠিকঠাক করা। পাত্রপাত্রী খোঁজার জন্য প্যাকেজ আছে। ১৮টা খোঁজ দিলে ২৫ হাজারের প্যাকেজ। আবার ১০টার খোঁজ নিতে চাইলে ১৫ হাজারেই হয়ে যাবে। দুই পক্ষের আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্যও আলাদা প্যাকেজ রয়েছে। ঝাঁ চকচকে অফিসে পুরুষ কর্মী একজনই। বাকি সবাই মহিলা। প্রত্যেকেই আলাদা চেম্বারে ল্যাপটপে মগ্ন। সেসব দেখে ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়ার উপায় নেই আদতে কী চলছে অফিসে। ম্যারেজ এগজিকিউটিভের দাবি, অন্য ম্যাট্রিমনি সংস্থাগুলির মতো তাদের কাজ অনলাইনে হয় না। পাত্র দেখা থেকে কথাবার্তা সবটাই অফলাইনে। তাহলে সারাক্ষণ ল্যাপটপ খুলে কী কাজ করছেন কর্মীরা? তার উত্তর মেলেনি।
প্রতারণার জালে পা গলিয়েছিলেন ভক্তিনগরের মোহন আগরওয়াল। মেয়ের বিয়ের জন্য নিয়েছিলেন এক লাখি প্যাকেজ। শুধু প্রোফাইল দেখানোই নয়, দুই পক্ষের আলাপ করিয়ে দেওয়াও তাঁর প্যাকেজে ছিল। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেলেও কয়েকটি ফোন নম্বর ছাড়া কিছুই দেওয়া হয়নি তাকে। তাতেই সন্দেহ বাড়ে মোহনের। তাঁকে যে কয়েকটি পাত্রের খোঁজ দেওয়া হয়েছিল আলাদা করে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। তারপরই সামনে আসে আসল তথ্য।
ওই পাত্রদের একজন জানান, তাঁরা পাত্রী খুঁজছেন ঠিকই, তবে সেবক রোডের ম্যাট্রিমনি অফিসের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগাযোগ নেই। তাঁরা দেশের নামকরা একটি ম্যাট্রিমনি সাইটে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। আর একজন জানান, মাস দুয়েক আগেই তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া তিনি সেবক রোডের ওই ম্যাট্রিমনি সংস্থার নামই শোনেননি কোনওদিন।
তাহলে ওই সংস্থার হাতে তাঁদের প্রোফাইল গেল কীভাবে? ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সেবক রোডের সংস্থাটির কারবারিরা ভুয়ো পরিচয়ে নাম করা ম্যাট্রিমনি সাইটগুলির গ্রাহক সেজে তাদের কাছ থেকে পাত্রপাত্রীদের প্রোফাইল নেয়। তারপর নানা অছিলায় একের পর এক প্রস্তাব নাকচ করে। প্রস্তাব নাকচ করলেও পাত্রপাত্রীর প্রোফাইল, ফোন নম্বর কারবারিদের কাছে থেকেই যায়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে তারা নিজেদের ডেটা ব্যাংক তৈরি করে। তাছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাত্রপাত্রী কলাম থেকে বিজ্ঞাপনগুলি সংগ্রহ করে সেগুলিও নিজেদের নিজস্ব ডেটা ব্যাংকে ঢুকিয়ে দেয়। কেউ তাদের অফিসে এলে সেই ‘চুরি করা’ ডেটা ব্যাংক থেকেই পাত্রপাত্রীর তথ্য, মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়। কিন্তু দু’পক্ষের মধ্যে কথা বলিয়ে দিতে পারে না তারা।
ঠকেছেন বুঝেই থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মোহন। বেকায়দায় পড়ে কিস্তিতে টাকা ফেরত দিতে রাজি হন কারবারিরা। মোহনের কথা, ‘শুধু অফিসটাই আছে। বাকি সবটাই ভুয়ো। এখনও পুরো টাকা ফেরত পাইনি। সময়মতো টাকা না পেলে ফের আইনি পদক্ষেপ করব।’ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই সংস্থার ডিরেক্টর পরিচয় দিয়ে নেহা বর্মন অবশ্য সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কোনও বেআইনি কাজের সঙ্গে আমরা যুক্ত নই।’
ঘটনাচক্রে মোহন টাকা ফেরত পেলেও অনেকেই তা পাননি। ভিনজেলার প্রতারিতরা শিলিগুড়ি শহরে এসে থানা-পুলিশ করতে না পারায় প্রতিকারও পাচ্ছেন না। পারমিতার কথাই ধরা যাক। বোনের বিয়ের জন্য ১৮ হাজার টাকা দিয়ে ওই অফিসে রেজিস্ট্রেশন করে প্যাকেজ কিনেছিলেন তিনি। তাঁর কথা, ‘নগদ টাকা দিয়েছলাম। আমাদের একটিও পাত্র দেখানো হয়নি। প্রতিবাদ করায় উলটে আমাকেই দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। ইসলামপুর থেকে এসে সেভাবে কিছু করতেও পারছি না।’
পুরনিগমের ডেপুটি মেয়র রঞ্জন সরকার এবং শিলিগুড়ি পুলিশের এডিসিপি শুভেন্দ্র কুমার দুজনেই প্রতারিতদের তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠছে, কেউ অভিযোগ না জানালে শহরজুড়ে নজরদারি চালানোর দায়িত্ব কি নেই পুরনিগম বা পুলিশের? সেই উত্তর অধরাই থেকে গিয়েছে। বেআইনি কলসেন্টারের রাজধানী শিলিগুড়িতে এর আগেও ওই ধরনের ‘কর্পোরেট’ অফিসের আড়ালে কলসেন্টার ধরা পড়েছে। ম্যাট্রিমনি সংস্থার বোর্ডের পিছনেও সেই ধরনের কোনও কারবার চলছে না তো ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের ওই অফিসে? দিনের শেষে সেই প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছে।