Friday, March 29, 2024
Homeপুজো স্পেশালআত্মমাতা, জগন্মাতা

আত্মমাতা, জগন্মাতা

পবিত্র সরকার

আমার অন্য কোনও বিষয়ে অহংকার করার কিছু না থাকুক, একটি বিষয়ে রীতিমতো অহংকার আছে। কিন্তু যেহেতু এ অহংকার আমার স্বোপার্জিত নয়, এবং এ ব্যাপারে আমার নিজের কোনও কৃতিত্বও নেই, তাই এ অহংকার আমি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। তবে আমার আত্মজীবনী অল্প পুঁজির জীবন-এ এ কথা সবিস্তারে আছে, কারণ ওই একটা জায়গায় নিজের কথাই যথাসম্ভব বলা নিয়ম।

যাই হোক, যেটা নিযে এত ভণিতা, তা হল আমার মায়ের সংখ্যা অন্য মানবসন্তানের তুলনায় একটু বেশি। দেবতাদের তুলনায় অবশ্যই নয়। গণেশের নাকি দুটি মাতা (দ্বিমার্তু) ছিল, কার্তিকের ছয়টি মাতা, কিন্তু আমি অত মহিমান্বিত কেউ না হলেও আমার মায়ের সংখ্যা মোট তিন। না, কোনও রূপক অর্থে নয়। পৃথিবীর সব মেয়ে মা, বা আমার নিজের দুটি মেয়ে আমার এক হিসেবে মা এরকম টানাটানির অর্থে নয়। একটা চেনা সামাজিক প্রথার কারণে। আমি দত্তক পুত্র। তাও পৃথিবীর শতকরা নিরানব্বইজন পোষ্যপুত্রের দুটি মা হওয়াই সাধারণ নিয়ম, আমার তিনটি মা হল কী কারণে? সে কারণ, আমাকে যিনি দত্তক নিয়েছিলেন, সেই আমার পিসেমশাই, তিনি আমার দুই পিসিমাকে দুই পর্যায়ে বিয়ে করেছিলেন। বড়জনকে প্রথমে; তাঁর কোনও সন্তান হল না বিধায় তারপরে ছোট পিসিমাকে। তিনিও পিসেমশাইকে সন্তান উপহার দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অগত্যা দুধের বদলে ঘোল, পিসিমাদের দাদার নবজাত পুত্রসন্তান আমাকে তাঁরা গ্রহণ করলেন। ওই দাদার একাধিক পুত্রকন্যা ছিল, ফলে একটিকে দুঃখী বোনেদের দান করতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। ফলে আমি যখন মায়ের কথা লিখি, আমাকে সবসময় বহু বচনের রূপ প্রয়োগ করতে হয়। মায়ো, মায়েদের ইত্যাদি।

লোকে বলে সংখ্যা বা quantity বেশি হলে quality একটু ক্ষুণ্ণ আর দুর্বল হযে পড়ে। আমার মায়েদের ক্ষেত্রে তা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। জন্মদাত্রী মা যেহেতু অন্য পরিবারের হয়ে গেলেন, আমার জীবন-নির্ধারণে তাঁর আর কোনও হাত রইল না। কিন্তু তিন মাসের শিশুকে দুধ খাওয়ানোর জন্য তিনি ওই শিশুর সঙ্গে তার নতুন বাড়িতে চলে এলেন যমজ কন্যা সহ, তাকে বৎসরাধিক কাল বুকের দুধ খাইয়ে গেলেন, তাই বা কম কী? তা ছাড়া তাঁর কাছ থেকে, আর জন্মদাতা পিতার কাছ থেকে আমি যে জিন পেয়েছি, তা তো আমার মৃত্যু পর্যন্ত কাজ করেই চলবে, সেখানে আমার অন্য মায়ো বা পালক পিতা তো আর ভাগ বসাতে পারবেন না। আমি দেখা হলেই তাঁর বিষণ্ণ স্নেহময় দৃষ্টিতে অভিষিক্ত হতাম। আমার সান্ত্বনার কথা যে, শেষ জীবনে তিনি আমার কাছে এসেই পুত্রবধূর সেবা আর নাতনির সুখ দেখে বিদায় নিয়েছেন।

অন্য দুই মা, বড়পিসিমা ছোটপিসিমা, পরে আমার বড়মা ছোটমা, দুজনে ছিলেন দুই রকমের। বড়মা ছিলেন ফর্সা, দেবীপ্রতিমার ধরনে সুন্দরী, শান্ত, নরম স্বভাবের, কিন্তু কাজেকর্মে নিরতিশয় পটু। এক গ্রামের লোকের রান্না, অতি সুস্বাদু রান্না–তিনি একাই নামিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর গানের গলাও ছিল অতিশয় মধুর, তিনি আমাকে ছেলেবেলায় গান গেয়ে আর রূপকথা বলে ঘুম পাড়াতেন। ছোটমা ছিলেন কিছুটা উলটো। কালো, সে অর্থে সুন্দরী নন, শক্তপোক্ত চেহারা ও চরিত্রের, তাঁর কথাবার্তা ছিল স্পষ্ট ও কর্কশ। তিনি এসে আমার পালক পিতার সংসারকে অধিকার করে নিলেন, বড়মা প্রায় প্রান্তিক হয়ে পড়লেন সে সংসারে, এ নিয়ে বড়মার একটা গোপন দুঃখ ছিল, তাঁর কথা আমি যে বুকে কী পাষাণ বাইন্ধ্যা আসি তা আমাদের কাছে দীর্ঘশ্বাসের মতো প্রকাশিত হত কখনও-কখনও। সেই দুঃখ থেকে পলায়নের একটা উপায় তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন। তা হল, তীর্থভ্রমণ। প্রতি বছর তিনি তীর্থে যেতেন গ্রামের দলের সঙ্গে। কখনও চট্টগ্রামের, কখনও নারায়ণগঞ্জের শীতললক্ষ্যা নদীতে অষ্টমীর স্নান, কখনও দূরে পুরী, এমনকি কাশী ও বৃন্দাবন। এ ব্যাপারে পালক পিতা কোনও আপত্তি করতেন না। প্রতি বছর আমি তাঁর সঙ্গে যাব বলে আবদার করতাম। কিন্তু তিনি হয় আমাকে কোনও ছুতোয় অন্যের বাড়ি পাঠিয়ে বা আমাকে ঘুমন্ত রেখে চলে যেতেন। পরে আমি কান্নাকাটি দাপাদাপি করেছি, সেসব নিষ্ফলা গেছে।

কিন্তু ছোটমার কাছে আমি আমার জীবনের জন্য, এবং তার পরিণামের জন্য অশেষভাবে ঋণী। মাতৃঋণ পরিশোধ করার প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু আমার কৈশোরে একটি অসুখ (নাক বন্ধ-করা পলিপ) সারানোর জন্যে আটবার অপারেশন, বার চারেক অজ্ঞান করে, করানোয় তাঁর উদ্যোগ ও লড়াই ছিল অসামান্য। তার শুরু হয় ক্লাস এইটে, শেষ হয় বিএ পরীক্ষার পরে। এই দীর্ঘ রোগযাত্রায় ছোটমা ছিলেন আমার সঙ্গী ও ত্রাণকর্ত্রী। আর দ্বিতীয় এবং আরও বড় কথা, আমার লেখাপড়া সবই ছোটমার শুধু তাড়ন নয়, অভূতপূর্ব আত্মক্ষয়কারী পরিশ্রমের ফল। ওই ক্লাস এইটেই যখন পড়ি, পালক পিতার মৃত্যু (১৯৫১) হল, আমাদের সংসারে হঠাৎ অভাব ঘনিয়ে এল। আমার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু ছোটমা তাঁর গ্রামীণ সংকল্প নিয়ে মুড়ি ভেজে, গোরুর দুধ বিক্রি করে, বাড়িভাড়ার সামান্য আয়কে পুষ্ট করেছেন, আমার কলকাতায় কলেজে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যাতে ব্যাহত না হয়, তার জন্য প্রাণপণ করেছেন। আমার জীবনে আমি যদি কোথাও পৌঁছে থাকি, তা এই দৃঢ়চিত্ত, কোনও যুদ্ধে হার-না-মানার সংকল্পবদ্ধ, প্রায় নিরক্ষর মহিলাটির জন্য। তাঁর স্নেহের প্রকাশ মুখে বা আচরণে বেশি ছিল না, আমি তাঁর মধ্যে কঠোরতাই বেশি দেখতাম। তাঁকে যতটা ভালোবেসেছি, তার চেয়ে ভয় করেছি বেশি। কিন্তু আমার জীবনের যা কিছু, আমার আয়ুষ্কাল সবই এই আমার চোখে অসামান্য নারীটির কাছে বাঁধা পড়ে আছে। আমার তিন মা-ই আমার সংসারে থেকে একে একে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু এই মা-টিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পৃথিবীর সব মা থেকে আলাদা করে রাখি। আমার আত্মজীবনী অল্প পুঁজির জীবন-এ এঁদের কথা পাঠক আর-একটু বেশি পাবেন।

পুজোর উপলক্ষ্য, কাজেই জগজ্জননীর কথায আসি, নইলে সম্পাদক মশায়ে কথা রাখা হবে না। শৈশবে-কৈশোরে বিশ্বাস ছিল কিছুটা, কিন্তু যৌবনে পৌঁছে দেবদেবী বা ঈশ্বর আমার মনোভূমি থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমার জীবনে দেবদেবী বা গ্রহনক্ষত্রের কোনও ভূমিকা আছে বলে অনেকদিন মনে করি না। তবু মানুষ সব আশ্চর্য আনন্দের উৎসব তৈরি করেছে এই বিশ্বাসকে ঘিরে, মানুষের সেই আনন্দ দেখতে ভালো লাগে, বিশেষত শিশুদের আনন্দ। গ্রামের একটিমাত্র পুজোতে আনন্দ করেছি, বিসর্জনে বা দশমীতেও; আর শহরের নানা পুজোমণ্ডপ একসময় চষে বেড়িয়েছি। প্রতিমা ও মণ্ডপসজ্জা বিচারের দায়ও পালন করেছি কয়েক বছর নানা সংবাদপত্রের হয়ে কিন্তু এখন আমি ঘরে বসে, অলিন্দবাসীর মতো মানুষের আনন্দের শোভাযাত্রা দেখি। তাই ভালো লাগে। বহু রাত্রি পর্যন্ত মণ্ডপ পরিক্রমাকারী মানুষের কোলাহল শুনি, শুনি শিশুদের খেলনা পিস্তলের শব্দ বা বেলুনের গা ঘষটে বার-করা আওয়াজ। এই আনন্দ যেন চিরকাল থাকে। পৃথিবীতে যুদ্ধের পর যুদ্ধ তৈরি হচ্ছে, দেশে বিশ্বাস থেকে হিংস্রতার মহড়া চলে। বাবা হোন, মা হোন কোনও দেবদেবী পৃথিবীতে মানুষের দ্বন্দ্ব আর হিংসার কোনও সুরাহা করতে পারে না, প্রকৃতির প্রতিহিংসারও না। তার মধ্যে মানুষ যদি ব্যাকুল হয়ে আনন্দের সন্ধান করে, করুক।

Sourav Roy
Sourav Royhttps://uttarbangasambad.com
Sourav Roy working as a Journalist since 2013. He already worked in many leading media houses in this few years. Sourav presently working in Uttarbanga Sambad as a Journalist & Sud Editor of Digital Desk from March 2019 in Siliguri, West Bengal.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img
[td_block_21 custom_title="LATEST POSTS"]

Most Popular