Saturday, April 20, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ভারতরত্নের থিয়োরিটিক্যাল ক্লাসে মোদি

ভারতরত্নের থিয়োরিটিক্যাল ক্লাসে মোদি

আদবানি বলতেন, রাম মন্দির নির্মাণ আমার কাছে নতুন ভারত নির্মাণের মতো। আন্দোলনটা শুধু মন্দির নির্মাণের নয়।

  • জয়ন্ত ঘোষাল

লালকৃষ্ণ আদবানির আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালের ১৯ মার্চ। দিল্লির বিরাট শ্রীফোর্ট মেন অডিটোরিয়ামে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম আজাদ এই বইটির আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন। গোটা প্রেক্ষাগৃহ থিকথিক করছে মানুষ। একদম সামনের সারিতে বসে দলের শীর্ষনেতারা। আর একদম উপরের গ্যালারিতে দলের নানা স্তরের কর্মীরা।

অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে যাবার পর বিজেপির আরেক শীর্ষনেতা, প্রয়াত অরুণ জেটলি আমাকে বলেছিলেন, ২০০৯ সালে লোকসভা ভোট। তার আগে আদবানি এইরকম ১০০০ পৃষ্ঠারও বেশি মহাভারতসম আত্মজীবনী প্রকাশ করে কি ঠিক কাজ করলেন? আমি জেটলিকে পালটা জিজ্ঞাসা করলাম, কেন একথা বলছেন? জেটলি বললেন, ‘আসলে আত্মজীবনী যখন কোনও রাজনৈতিক নেতা লিখে ফেলেন, তার মানে হচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি তিনি ঘোষণা করছেন। এই বইটা এখনই আদবানি লিখে ফেললেন। তাহলে ২০০৯ সালের ভোটে তিনি কীভাবে দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন, যেটা তিনি অন্তর থেকে চান?’

এই বইটি এক লক্ষেরও বেশি বিক্রি হয়েছে। আজ এতবছর পর যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে সম্মানিত করলেন, অনেকেই বলছেন এ হল গুরুদক্ষিণা। শিষ্য এই গুরুদক্ষিণাটা দিয়ে দুনিয়াকে দেখালেন, তিনি অনুগত শিষ্যই বটে।

৩০ নম্বর পৃথ্বীরাজ রোডের বিরাট বাংলোতে শীতের দুপুরে ৯৬ বছরের মানুষটি ঋজু ভঙ্গিতে এখনও এসে দাঁড়ান। লনের সামনে বসতে ভালোবাসেন। তাঁর জন্যে একটা আলাদা টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা করেছেন কন্যা প্রতিভা। সেখানে বসে বাবা প্রাতরাশ করেন। মেয়ে অনেক সময় বাবাকে সুপ খাইয়ে দেন। কমলা আদবানি যতদিন ছিলেন, ততদিন আদবানি খুব সুস্থ ছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর ক্রমশ আরও ভেঙে পড়েছেন।

২২ জানুয়ারি রাম-বালক রামের মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল। নুতন মন্দির গঠন হল। যে অযোধ্যা আন্দোলন একদিন শুরু করেছিলেন আদবানি। হিমাচলে যখন বিজেপির জাতীয় কার্যকরী সমিতির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, এই আন্দোলন হবে, তখন কিন্তু আদবানি দলের সভাপতি। সেদিন অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন। তিনি এই আন্দোলন মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু আন্দোলন শুরু হয়েছিল সোমনাথ মন্দির থেকে।

আমি আদবানিজির সঙ্গে রথযাত্রায় বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে দেখেছি, সেদিন মোদি সবসময় তাঁর পাশে পাশে ছিলেন। কখনও তাঁর মাইকটা ধরছেন, ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের বাইরে আদবানি বক্তৃতা দিচ্ছেন পাশে মোদি। কিন্তু অযোধ্যায় রাম মন্দিরের জাতীয় অনুষ্ঠানে আদবানি শামিল হতে পারেননি। তিনি সেই শারীরিক ও মানসিক অবস্থতাতেও আজ আর নেই। বড় নিঃসঙ্গ।

একদিন এই আদবানি হিন্দুত্বকে তুলে ধরেছিলেন অন্য ভঙ্গিতে। এমনকি রাম মন্দিরের আন্দোলন করতে গিয়ে ৬ ডিসেম্বর যখন বাবরি মসজিদ ভেঙে গেল, তখন তিনিই কিন্তু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রবন্ধ লিখে বলেছিলেন যে তিনি দুঃখিত। বাবরি মসজিদের এই ধ্বংসটা তিনি চাননি বা বিজেপির উদ্দেশ্য ছিল না।

সেইসময় বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রণয় রায় আদবানির একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে প্রণয় প্রশ্ন করেছিলেন, আপনারা দাঁড়িয়ে ছিলেন এক কিলোমিটারের মধ্যে, আপনাদের সামনে মসজিদটা ভেঙে গেল। আর আপনি বলেছেন ভাঙাটা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না এবং আপনি দুঃখিত। কিন্তু তাহলে কি এটা নেতৃত্বের ব্যর্থতা নয়? আদবানি স্বীকার করেছিলেন সেই সাক্ষাৎকারে, ‘হ্যাঁ! এটা নেতৃত্বের ব্যর্থতা। আমরা আমাদের নীচুতলার কর্মীদের শৃঙ্খলার মধ্যে ধরে রাখতে পারিনি। আরএসএসের সংগঠন আমি করেছি প্রথম। তারপর জনসংঘ, তারপর বিজেপিতে এসেছি। আরএসএস আমাদের শৃঙ্খলা শিখিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৬ ডিসেম্বর আমরা শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারিনি। উমা ভারতীকে প্রথমে পাঠিয়েছিলাম, যারা ধ্বংস করছে তাদের থামাতে। কিন্তু উমা ফিরে এসে বলেছিলেন, ওরা মারাঠি ভাষায় কথা বলছে। আমার কথা বুঝতে পারছে না। তখন প্রমোদ মহাজনকে পাঠানো হয়েছিল।’

আসলে আদবানি হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, শিবসৈনিকেরা মূলত এই ধ্বংসের কাজে এগিয়ে যায়। পরবর্তীকালেও, ক’দিন আগেও উদ্ধব ঠাকরে দাবি করেছেন, শিবসেনাই সব থেকে বড় কাজটা করেছিল। সেই উদ্ধবও কিন্তু আজ এই জাতীয় উৎসব থেকে অনেক দূরে। কেননা তিনি এখন এনডিএ’র সদস্য নন।

রাজনীতিতে এই পরিবর্তন চলতেই থাকে। এর বিবর্তন আদবানির ক্ষেত্রেও হয়েছে। আদবানি কোথায় ছিলেন, কীভাবে ছিলেন। হিন্দুত্বটাকে মূলধন করে তিনি এগিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বারবার বলেছেন, বিজেপি কিন্তু মুসলিম বিরোধী দল নয়। বিজেপি সবসময় মনে করে, হিন্দুত্ব এমন একটা মতাদর্শ, যা অখণ্ড ভারতের সমস্ত সম্প্রদায়কে নিয়ে এগোনোর মতবাদ। আদবানিই বিজেপির প্রথম নেতা যিনি বিজেপিকে ২ থেকে প্রায় ২০০ আসনে নিয়ে এসেছেন। আজ সেই আদবানি তাঁর বাংলোতে বসে থাকেন। কিন্তু জাতীয় রাজনীতি থেকে তিনি সহস্র যোজন দূরে।

৯৬ বছর বয়সে আর কীই বা হতে পারে! মুরলীমনোহর যোশি তাঁর বাড়িতে এসেছেন, ‘ভারতরত্ন’ পাওয়ার পর তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মোদি ফোন করে প্রথমে খবর দিয়েছেন। আদবানির জন্মদিনে মোদি হাতে গোলাপের স্তবক নিয়ে আদবানির কাছে আসেন। আপাতত আদবানি এগুলোকেই তাঁর জীবনের মস্ত বড় পাওয়া বলে মেনে নিয়েছেন। আমি একবার আদবানিকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি তো প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি, মোদি পেরেছেন। গুরু পারেননি, শিষ্য পেরেছেন। এটা কীভাবে নেন? তিনি বলেছিলেন, ‘নরেনের মধ্যে (আদবানি কিন্তু মোদি বলেন না, নরেন বলেন) প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রসদ ছিল। কোনও ব্যক্তির রাজনৈতিক অভিলাষ খুব তীব্র হয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত একটা মানুষের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, তাগিদ খুব তীব্র না হয়, ততক্ষণ সেটা প্রাপ্তির লক্ষে যেতে পারে না।’

আমি ওঁর কথাটা বুঝতে পেরেছিলাম। ঠিক যেমনটা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম সিপিএমের অপসারণের দাবিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ কয়েক দশকের আন্দোলনে। মমতার মধ্যেও সেদিন একটা একমুখী উদ্দেশ্য দেখেছিলাম। এটা কিন্তু ২০১৪ সালের আগে মোদির ক্ষেত্রেও দেখেছি।

আদবানি সেটাই বলতে চেয়েছেন। মোদি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন যেদিন, সেদিন তিনি বিধানসভার সদস্য ছিলেন না। কোনওদিন বিধানসভার ভিতরে যাননি। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে যাননি। তিনি হলেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন যখন, তিনি সংসদেরও সদস্য নন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেকথা তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন। আদবানি বারবার তাই বলেছেন, নরেনের ক্ষেত্রে এটা তাঁর মানসিক একটা তীব্র প্রবৃত্তি ছিল। সেটা তাঁর সাফল্য। সবার মধ্যে এই মানসিক বৃত্তিটা থাকে না।

অনেক দিন আগের কথা! আদবানির সঙ্গে যখন রথযাত্রায় যাচ্ছিলাম, তখন কিন্তু উনি বারবার বলেছিলেন, রাম মন্দির নির্মাণ আমার কাছে ‘ভারত নির্মাণের’ মতো। আমাদের আন্দোলনটা শুধু মন্দির নির্মাণের আন্দোলন নয়। একটা নুতন ভারত নির্মাণের আন্দোলন। সেই কারণেই নবীন প্রজন্মও কিন্তু এই আন্দোলনে শামিল। আজ মোদিও সেকথাই বলছেন। অর্থাৎ অখণ্ড ভারতের সাংঘাতিক সম্ভাবনায় যে উন্নয়নের যে প্রেক্ষিত, তার সঙ্গে মোদি রাম মন্দির প্রতিষ্ঠাকে যুক্ত করেছেন। এখন মনে হয় আদবানি থিয়োরিটিক্যাল ক্লাস নিয়েছিলেন মোদির। মোদি ভারতের ল্যাবরেটরিতে তারই প্র্যাকটিকাল কাজ করছেন।

তবে সেদিন যখন আদবানি উপপ্রধানমন্ত্রী, সেদিন যখন রাম মন্দির আন্দোলনের নায়ক, তখন কাতারে কাতারে মানুষ আসত তাঁর কাছে। কত গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আসতেন, আদবানিজির কাছে কিছু না কিছু চাইতে আসতেন। আজ কিন্তু সেভাবে মানুষ, সেই ভিড় দেখা যায় না। এটাই রাজনৈতিক বাস্তবতা। আজ যখন আদবানিজির সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে। আদবানির সঙ্গে দু’মিনিটের জন্যে দেখা করার জন্যে হয়তো ২০০টা মানুষ অপেক্ষা করতেন। আজ সেসব শুধুই স্মৃতি।

তবুও ‘ভারতরত্ন’র মতো সম্মান পেয়ে আদবানি হয়তো মনে মনে ভাবছেন, আজ কমলা থাকলে খুব খুশি হত। অর্থাৎ না পাওয়ার নানা বেদনায় সাক্ষী ছিলেন স্ত্রী কমলা। কিন্তু ‘ভারতরত্ন’ পাওয়ার দিনটিতেই তিনি নেই।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Fire | মাঝরাতে মৌলানি বাজারে বিধ্বংসী আগুন

0
শুভদীপ শর্মা, মৌলানি: বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের (Fire) ঘটনা ঘটল মৌলানি বাজারে। জানা গেছে, শুক্রবার রাত আনুমানিক বারোটা নাগাদ ক্রান্তি ব্লকের এই বাজারে থাকা একটি দোকান...

IPL-2024 | মাহি ম্যাজিক ফিকে হল রাহুল-ডি’ককের দুরন্ত ব্যাটিংয়ে, চেন্নাইকে হারিয়ে জয় হাসিল করল...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ফের মাঠ কাঁপালেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। মাহির দুরন্ত ব্যাটিং সত্ত্বেও লখনউ সুপার জায়ান্টসের কাছে হেরে গেল চেন্নাই সুপার কিংস। ধোনির...

CCTV | বুথের সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যাগ ফেলেই চলে গেল ভোটকর্মীরা, উদ্ধার করল এনজেপি থানার...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ শুক্রবার রাতে রাস্তার পাস থেকে উদ্ধার হল ৮ টি ব্যাগ ভর্তি সিসিটিভি ক্যামেরা। এদিন রাতে এগুলি উদ্ধার হয় শক্তিগড় ২...

Lok sabha election 2024 | দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ! রাজ্যের দুই ওসিকে সাসপেন্ড করল নির্বাচন...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ নির্বাচন কমিশনের দেওয়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় রাজ্যের দুই ওসিকে সাসপেন্ড করল নির্বাচন কমিশন। শুক্রবার কমিশনের তরফে একটি চিঠিতে এই...

Political Violence | বুথ থেকে বের হতেই প্রাণঘাতী হামলা শিলিগুড়িতে, লুটিয়ে পড়লেন বিজেপির পোলিং...

0
শিলিগুড়ি: পোলিং বুথ থেকে বের হতেই বিজেপির (Bjp) পোলিং এজেন্ট শ্যামল সরকারের উপর প্রাণঘাতী হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। জানা গিয়েছে, এই ঘটনায়...

Most Popular