প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমানঃ রেশন দুর্নীতির মামলায় ইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। এর আগে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করেছিল ইডি। এবার ইডি গ্রেপ্তার করল প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। তবে দুই মন্ত্রীর গ্রেপ্তার হওয়ার মূলে থাকা অভিযোগটা অবশ্য আলাদা। শিক্ষা দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পার্থ এখন শ্রীঘরবাসী। আর জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালু কে ইডি গ্রেপ্তার করেছে রেশন দুর্নীতি মামলায়।
এদিকে রেশন দুর্নীতি মামলায় স্বাধীনতা সংগ্রামী শক্তিপদ মল্লিকের ছোট ছেলে জ্যোতিপ্রিয় গ্রেপ্তার হতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরের পূর্ব খাঁপুর গ্রামে। কেউ কেউ বলছেন বালুর গ্রেপ্তারিতে মন্তেশ্বরের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল, মন্তেশ্বরের উন্নয়নটাই এবার থমকে যাবে। আবার এলাকার বিরোধীদের মত বালুকে আরও আগে গ্রেপ্তার করা দরকার ছিল।
মন্তেশ্বরের বামুনপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্ব খাঁপুর গ্রামে রয়েছে প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকদের পৈত্রিক বাড়ি। এই গ্রামেরই ভূমিপুত্র তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী শক্তিপদ মল্লিকের ছয় পুত্র ও চার কন্যার মধ্যে জ্যোতিপ্রিয় সবার ছোট। দাদা দেবপ্রিয় মল্লিক স্বনামধন্য চিকিৎসক। পৈত্রিক ভিটেতে এখনও রয়েছে মাটির দেওয়াল আর টিনের চালার সাবেকি বাড়ি। অদূরে পারিবারিক জমিতে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নিজস্ব একটি বাড়ি রয়েছে। উঁচু পাঁচিল ঘেরা বিশাল জায়গার উপর থাকা বাড়িটিও চোখ ধাঁধানো। ওই বাড়ির মূল ফটকের দেওয়ালে থাকা ফলকে লেখা রয়েছে স্বর্গীয় পিতা শক্তিপদ মল্লিক ও স্বর্গীয় মাতা নবনলিনী মল্লিকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই বাড়ির নামকরণ ‘নবশক্তি ভবন’ করা হয়েছে।
শুক্রবার ওই বাড়িতে পৌছে অনেক ডাকাডাকি করেও নিস্তব্ধতা ছাড়া আর কোন জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। বাড়ির সব দরজাই ছিল বন্ধ। তবে আশপাশের বাসিন্দাদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাঁদের গ্রামের ছেলে তথা রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ইডি’র হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার কথা। ইডি’র আধিকারিকরা এই বাড়িতেও তল্লাশি চালাতে আসতে পারে এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ায় এদিন এই বাড়ির দিকে নজরও রেখে চলেছিলেন গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁদের কথাতেই জানা গেল অন্যান বছরের মত এ বছরও দুর্গাপুজোর নবমীতে মন্তেশ্বরের বাড়িতে আসার কথা ছিল বালুর। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে তিনি আসেননি। এরপর এদিন সকালে টেলিভিশনের খবরে গ্রামবাসীরা জানতে পারেন রেশন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে ইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন গ্রামের ছেলে বালু।
গ্রামের বাসিন্দা বিকাশ মণ্ডল, জিতেন দাসরা বলেন, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আমাদের গ্রামের অনেক উন্নয়ন করেছেন। রাস্তাঘাট, আইআইটি কলেজ, জলের প্রকল্প সহ আরও অনেক কাজ তার উদ্যোগেই সম্পাদন হয়েছে। মন্ত্রীর পরিবার অত্যন্ত বনেদি পরিবার। মন্ত্রীর বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁদের সম্পত্তি আগে থেকেই ছিল। মন্ত্রীর সম্পত্তি এখন দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে বলে যা বলা হচ্ছে তা মানতে চাননি গ্রামবাসীরা। তাঁদের দাবি, দান ধ্যান করায় মন্ত্রীর পরিবারের সম্পত্তি বরং কমেছে।
মন্তেশ্বরে মন্ত্রীর যে বাড়িটি রয়েছে সেখানে শুধুমাত্র দুর্গাপুজোর সময়েই তিনি আসতেন। বাকি সারা বছর ওই বাড়িতে কেউ থাকে না। মন্ত্রী ও তাঁর পরিবার কলকাতাতেই থাকেন। গরিবের রেশনের খাদ্য সামগ্রী নিয়ে গ্রামের ছেলে বালু দুর্নীতি করে থাকতে পারেন না বলেই বিকাশ মণ্ডল, জিতেন দাস মত প্রকাশ করেছেন। তবে জ্যোতিপ্রিয় গ্রেপ্তার হওয়ায় উৎফুল্ল মন্তেশ্বরের বিজেপি ও সিপিএম নেতারা।
বিজেপি নেতা ঝুলন হাজরা বলেন, পূর্ব খাঁপুর গ্রামে রয়েছে মন্ত্রীর বিলাসবহুল প্রসাদপ্রোম একটি বাড়ি। এই বাড়িটি সিসিটিভি ক্যামেরায় মোড়া। মন্ত্রীর বাড়ির লাগায়া জায়গায় রয়েছে একটি রেশন দোকান। এই রেশন দোকানটি মন্ত্রীর এক ভাইয়ের নামে রয়েছে। মন্ত্রী তার নিজের প্রভাব খাটিয়ে নিজের পরিবারের সদস্যদের নামেও রেশন দোকান সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিতে পিছু পা হননি। সেই সঙ্গে মন্ত্রী ও তার পরিবারের প্রচুর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিও গ্রামে রয়েছে। বাকিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই বোঝা গিয়েছিল এবার জ্যোতিপ্রিয়র পালা। সেটাই হয়েছে। তবে আরও আগে এটা হওয়ার দরকার ছিল বলে বিজেপি নেতা ঝুলন হাজরা মন্তব্য করেছেন।
আর সিপিএম নেতা ওসমান গনি সরকার দাবি করেন, মন্তেশ্বরের বামুনপাড়া মন্ত্রীর ভাইয়ের নামে একটি আইআইটি কলেজ রয়েছে। ওই কলেজটি বেশ কয়েক বিঘা সম্পত্তির উপর তৈরী হয়েছে। কেন্দ্রীয় এজেন্সি ওই আইটিআই কলেজে হানা দিতে পারে এমন আশঙ্কায় ওই কলেজের সাইনবোর্ডটি রঙ দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে। এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ওই আইটিআই কলেজ নিয়েও কোন ঘোটালা আছে। ওসমান গনির আরও অভিযোগ, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের পরিবারের অতীতে যত সম্পত্তি ছিল তা বহু গুন বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর মন্ত্রী হবার পর। বর্তমানে ৭০-৮০বিঘার সম্পত্তি রয়েছে মল্লিক পরিবারের।