- পার্থ চৌধুরী
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহরে চার্চগুলোর সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় আলোকমালার রংবেরঙের সাজ শহরকে মায়াবী করে তুলছে। শীত আসব আসব করেও আসছে না। তবে শীতের আমেজ নিয়ে আবহমানের সব উপাচারই চোখে পড়ছে এই সময়ে।
এই আবহে কেউ যদি আমাদের সমসাময়িকদের প্রশ্ন করে, পুরোনো দিনের কোনও ব্যাপারটা মিস করেন, তাহলে স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অন্যান্য প্রায় সব কিছুই বিবর্তিত হয়ে রয়ে গিয়েছে আজও। যুক্তির টানে তা মেনে নিতেই হয় আমাদের। তবে কিছু এমন জিনিস আছে যা বস্তুগতভাবে উত্তরবঙ্গের বড় বড় শহর থেকে হারিয়ে গেল সময়ে চাপে। জানি হয়তো আর ফিরে আসবেও না।
মনে পড়ছে রাতের পর রাত জেগে যাত্রা দেখার কথা। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশক হয়ে আশির দশকের প্রথমদিকজুড়ে শিলিগুড়িতে বসত যাত্রার আসর। নিউ সিনেমার মাঠে তো মাসাধিককালজুড়ে পালা দেখেছি ঘোরের মধ্যে। পাশাপাশি আসর বসত রামকৃষ্ণ ময়দান এবং বাঘাযতীন পার্কেও। স্কুল থেকে ফিরে চটপট পড়াশোনা শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে পালা দেখার মাদকতা মনে করলে আজও শিহরণ জাগে। যাত্রার আসর নিশির মতো ডাকত আমাদের। পরবর্তীতে কলেজ জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই মোহময় কাল।
আর কীসব পালা তখন! কত কত নামকরা দল! মধ্যমণি অবশ্যই নট্ট কোম্পানি। সঙ্গে সত্যম্বর অপেরা, রয়্যাল বীণাপাণি অপেরা, তরুণ অপেরা, প্রভাস অপেরা, স্বপন অপেরাগুলোও ছিল পাল্লা দিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও সব ডাকসাইটে। আমার সৌভাগ্য বড় ফণী, ছোট ফণী থেকে শুরু করে ভোলা পাল, অমিয় চ্যাটার্জি, দিলীপ চ্যাটার্জি, জ্যোৎস্না দত্ত, বর্ণালি ব্যানার্জি, ছবি রানি (পুং), চপলা রানি (পুং)-দের অভিনয় দেখে ধন্য হয়েছি। পরবর্তীতে স্বপন কুমার, শেখর গাঙ্গুলি, বিজন মুখার্জি, নিরঞ্জন দাস, অনাদি চক্রবর্তী, ছন্দা চ্যাটার্জি, শ্যামল ঘোষ কাকে ছেড়ে কার কথা বলব। সবাই দিকপাল একেকজন। হাস্যরসিক মাখন সমাদ্দারের কৌতুক অভিনয় আজও স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করছে।
পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক সব ধরনের পালাই সে সময় মানুষ দেখেছে সময়ান্তরে। গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, কালাপাহাড়, সোনাইদিঘি, একটি পয়সা, বাঙালি পালাগুলো দেখলে আজকের ডিজিটাল প্রজন্মের ছেলেমেয়ে কী বলত জানি না, কিন্তু আমরা মোহিত হয়ে থাকতাম সেসময়।
শান্তিগোপালের হিটলার, লেনিন, কার্ল মার্কস, নেতাজি পালার জগতে আলোড়ন তুলেছিল এই আঙিনায় রাজনৈতিক কাহিনীর প্রচলনে। আর এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটালেন উৎপল দত্ত। তিনি এমন কিছু যাত্রাপালা নিয়ে এলেন যা আপামর দর্শকের ভালোবাসা কেড়ে নিল। ঝড়, বৈশাখী মেঘ, সন্ন্যাসীর তরবারি, দিল্লি চলো সেসময় কাঁপিয়ে দিয়েছিল যাত্রা জগৎ।
দিনগুলো সব হারিয়ে গেল জীবন থেকে। তখন পালা আরম্ভ হত রাত এগারোটা-বারোটায়, আর শেষ হত আড়াইটা-তিনটায়। দলবদ্ধভাবে ফেরার পথে রাস্তা কাঁপিয়ে সেদিন দেখা চোখা চোখা ডায়লগগুলো আওড়াতাম আমরা, সঙ্গে বিখ্যাত যাত্রার হাসি, হি-হি-হু-হু-হা-হা-হা-হা। বাড়ি ফিরে সটান বিছানা। সেখানেও নিস্তার নেই, স্বপ্নে হানা দিত চেঙ্গিজ খাঁ রূপী শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাদশা রূপী মহেন্দ্র গুপ্ত বা জেনারেল ও’ডায়ার তপন কুমার। এখন যাত্রা উৎসব হলেও সেই সব জনপ্রিয় চরিত্র, জনপ্রিয় অভিনেতারা আর ফিরে আসেন না।
(লেখক শিলিগুড়ির নাট্যকর্মী)