প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ জাতীয় পুরস্কারবিজয়ী অভিনেত্রী রূপে একদিকে যেমন সম্মানিত; পাশাপাশি দুর্মুখ, উদ্ধত এবং কটুবাক্য পটিয়সী হিসেবে বিজেপি সাংসদ-অভিনেত্রী কিরণ খের ততধিক বেশি বিতর্কিত চরিত্র রূপে পরিচিত। বুধবার সংসদে পা দিয়েই আবারও তুমুল বিতর্ক উস্কে দিলেন ‘বাড়িওয়ালি’, ‘খামোশ পানি’, ‘সরদারি বেগম’ খ্যাত কিরণ খের। বুধবার লোকসভায় বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের ধরনা এবং বিক্ষোভ চলাকালীন ‘ইন্ডিয়া ফর মণিপুর’ পোস্টার ছিঁড়ে দু টুকরো করলেন তিনি। এখানেই না থেমে ছেঁড়া পোস্টারের দুটি অংশ বঙ্গ বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় এবং পঞ্জাবের কংগ্রেস সাংসদ রভনীত সিং বিট্টুর হাতে উপহার স্বরূপ তুলে দিতে দেখা যায় কিরণকে, যা নিয়ে বিরোধী শিবিরের প্রবল ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তিনি।
বুধবার দুপুরে লোকসভায় পা রাখেন কিরণ খের। সেই সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভুপেন্দ্র যাদবের তরফে পেশ হওয়া বন সংরক্ষণ সংশোধনী বিল নিয়ে আলোচনা চলছিল সংসদে। একই সঙ্গে, পাল্লা দিয়ে জারি ছিল ওয়েলে নেমে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের সংসদীয় প্রতিনিধিদের ধরনা এবং বিক্ষোভ অবস্থান। লোকসভায় পা দিয়েই সংসদে এহেন দৃশ্য দেখে মেজাজ হারান কিরণ। রাগত স্বরে তাঁকে কথা বলতে দেখা যায় অর্জুন রাম মেঘোয়াল, প্রহ্লাদ যোশী সহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে। বিরোধী ধরনার দিকে তর্জনী নিক্ষেপ করে উত্তেজিত ভঙ্গিতে তাঁকে অভিযোগ জানাতেও শোনা যায়। এমন সময়ে, নিজের আসনে ফিরে যাওয়ার পথে ‘ওয়েলে’র মধ্যে মুখোমুখি হন ডিএমকে নেতা দয়ানিধি মারাণের সঙ্গে। দয়ানিধি তখন ‘ইন্ডিয়া ফর মণিপুর’ পোস্টার হাতে ধরনায় আন্দোলনরত। তা সত্ত্বেও বর্ষীয়ান অভিনেত্রী এবং সাংসদ কিরণ খেরকে দেখে সৌজন্য প্রদর্শন করেন। সে সময় কিরণ তাঁর থেকে পোস্টার চেয়ে নিলে, মারাণ সৌজন্যতাপূর্বক কিরণের হাতে ‘ইন্ডিয়া ফর মণিপুর’ পোস্টারটি তুলে দেন। এর পর নিজ আসনে ফিরে আসতে আসতেই ফর ফর করে পোস্টারটি ছিঁড়ে দু ভাগ করে ফেলেন তিনি এবং কটাক্ষ করে উপহার স্বরূপ একটি ছেঁড়া অংশ তুলে দেন বঙ্গ বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের হাতে, অপরটি তুলে দেন পঞ্জাব কংগ্রেস সাংসদ রভনীত সিং বিট্টুর হাতে। প্রবীণ সাংসদের এই কান্ডে দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে গোটা ঘটনাটি দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বর্ষীয়ান ডিএমকে সাংসদ দয়ানিধি মারাণ।
কিরণ খেরের পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনায় রীতিমত অস্বস্তিতে পড়েছেন বাংলার অভিনেত্রী-সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানান, ‘উনি (কিরণ) বর্ষীয়ান অভিনেত্রী, সাংসদ৷ এমন কাণ্ড করবেন তা ভাবিনি। হঠাৎ দেখি আমার হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন একটি ছেঁড়া পোস্টার। এমনকি এও বলেন, এদের (বিরোধী শিবির) নাটক আমার সহ্য হয় না।’ লকেটের দাবি, ‘মতাদর্শগত বিরোধ থাকতেই পারে আমাদের এই বিরোধী শিবিরের সঙ্গে, সংসদীয় নিয়মে কক্ষে বা ওয়েলে পোস্টার প্রদর্শনও কঠোরভাবে বর্জিত, তবুও এমন কিছু করা অনুচিত।’ কিরণ খেরের এহেন অসংসদীয় আচরণের প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা সাংসদ-অভিনেত্রী শতাব্দী রায় বলেন, ‘কিরণজি আগেও এমন কাণ্ড বাঁধিয়েছেন। উনি সিনিয়র আর্টিস্ট, সকলের শ্রদ্ধেয়। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা সমর্থনযোগ্য নয়।’ শতাব্দী এও জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন দিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত কিরণ, তাঁর চিকিৎসাও চলছে। হয়তো তার জেরেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে এমন কাণ্ড তিনি ঘটিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু যা করেছেন তা চরম অবমাননাকর এবং তীব্র নিন্দনীয়; তা জানাতে ভোলেননি বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ-অভিনেত্রী শতাব্দী রায়।
বিশেষ উল্লেখ্য, এই ঘটনার প্রায় একই সময়ে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভুপেন্দ্র যাদবের তরফে পেশ হওয়া বন সংরক্ষণ সংশোধনী বিল নিয়ে আলোচনা চলাকালীন বক্তব্য রাখতে উঠে দার্জিলিং কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্ট অভিযোগ করেন, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বনাঞ্চল, বিশেষ করে গরুমারা, জলদাপাড়া, মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি, নেওড়া ভ্যালি, বক্সা টাইগার রিজার্ভ সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরেস্ট কোর এরিয়ায় শাসক দলীয় তৃণমূল সরকারের মদতে গড়ে উঠছে একের পর এক রিসর্ট, হোটেল ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল সরকার ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি তথা উদ্যোগপতিদের বেচে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এর ফলে প্রভাবিত হচ্ছে রাজ্যের পরিবেশ এবং বনসম্পদ, অভিযোগ করেন দার্জিলিং সাংসদ। নিজেকে মণিপুরের ‘ভূমিপুত্র’ আখ্যা দিয়ে এদিন বিরোধী শিবিরের ধরনা ও বিক্ষোভকেও নিম্নমানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেন রাজু বিস্টা। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরা সমস্বরে এর বিরুদ্ধে পালটা প্রতিবাদও জানান লোকসভায়।