রূপায়ণ ভট্টাচার্য
কথার মধ্যে লুকিয়ে স্পষ্টতই অভিমান। কংগ্রেসের নেতাটি মৃদু হেসে বললেন, ‘উত্তরবঙ্গে কোথাও সেভাবে সভা করলেন না বলে সেখানকার মানুষের ক্ষোভ কেন বলুন তো? রাহুলের কথা শুনে তাঁদের লাভটা কী হত? তাঁরা তো কংগ্রেসকে ভুলেই গিয়েছেন। ভোট তো এঁরা দেবেন তৃণমূল বা বিজেপিকে।’
বললাম, রাহুল কি আরও জনতার মাঝে যেতে পারতেন না?
সহাস্য উত্তরে জেগেছিল এবার বিদ্রুপ, ‘যেখানে লাভের কোনও আশা নেই, সেখানে বিনিয়োগের কি দরকার রয়েছে?’
রাহুলের ন্যায় যাত্রা নিয়ে উত্তরবঙ্গের কিছু শহরে ক্ষোভের খবর কাগজে বেরিয়েছে। অনেকের প্রশ্ন, কেন রাহুল একটা শহরেও সেভাবে পথে নামলেন না? এসব প্রশ্নে একটা জিনিস প্রমাণিত। এই বঙ্গে অধীর চৌধুরীর কল্যাণে ক্রমাগত শীর্ণ ও জীর্ণ হয়ে আসা, দুটি জেলায় আবদ্ধ কংগ্রেসে এখনও কিছু পাগল সমর্থক রয়েছেন। মৃতপ্রায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানেও যেমন রয়েছে। যাঁরা মানবেন না, কর্তাদের জন্য বড় দুটো ক্লাব অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। বাঙালি ফুটবলারই নেই, দুটো বড় ক্লাবের মাঠে খেলা কার্যত বন্ধ, ক্লাব হাতবদল হয়েছে, শাসকদলের নেতাদের হাতে ক্লাব, তো কীসের সেই স্বপ্নের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল হে বন্ধু?
মানতেই হবে, রাহুল গান্ধির গাড়ির পিছন পিছন এই বাজারেও যাঁরা অন্ধের মতো তেরঙায় সেজে দৌড়েছেন, তাঁদের এখনও কিছু আদর্শবোধ রয়েছে। অতীতে যা পার্টি সমর্থকদের মধ্যে থাকত। এখনও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ক্লাব সমর্থকদের মধ্যে যা আছে। কংগ্রেস বাংলায় ক্ষমতায় নেই ৪৭ বছর। কেন্দ্রে সরকারে নেই ১০ বছর। এই বাংলা এখন শুভেন্দু অধিকারী, নিশীথ প্রামাণিক, উদয়ন গুহ, মানস ভুঁইয়াদের দৌলতে আয়ারাম গয়ারামদের আদর্শহীন রাজ্যে পরিণত। দলবদলিয়াদের জন্য নানা মধুর টোপ নিয়ে বসে থাকে জোড়াফুল-পদ্মফুলের নেতারা। এমন এক দিগভ্রষ্ট রাজনীতির রাজ্যে একটা পুরোনো আদর্শ নিয়ে যাঁরা এখনও কংগ্রেসকে বুকে জড়িয়ে রয়েছেন, সত্যিকারের আদর্শবাদী তাঁরাই।
অনেক মানুষই ভারত জোড়ো যাত্রার সঙ্গে ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রাকে গুলিয়ে ফেলছেন এবং ফেলেছেন বলেই ভাবতেন, রাহুল ও সঙ্গীরা তাঁদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাবেন। অথচ আগেই ঘোষণা হয়েছিল, ন্যায় যাত্রা হবে মূলত বাসে। ভারত জোড়ো যাত্রার মতো হেঁটে নয়। ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর যে ভারত জোড়ো যাত্রা শুরু হয়, সেখানে দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রায় ৪০৮০ কিলোমিটার যাওয়া হয় ১৩৬ দিনে। এবার পূর্ব থেকে পশ্চিমে অনেক বেশি পথ যাওয়া হবে অনেক কম দিনে। এবার যাওয়া হচ্ছে প্রায় ৬২০০ কিলোমিটার। ৬৬ দিনে।
ন্যায় যাত্রা করেও যে উত্তরবঙ্গে কংগ্রেস কেন সেই নিরন্তর আঁধারেই পড়ে থাকবে, তার একটা কারণ বুঝিয়েছেন শিলিগুড়ির কংগ্রেসের নেতারা। শংকর মালাকারের মতো নেতারা অন্তত চারবার রাহুলের যাত্রার চাররকম রুট বলেছেন অতি হাস্যকরভাবে। মানে অত্যন্ত স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় স্তরের নেতাদের সঙ্গে শংকরদের কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগই ছিল না। রাজ্যের শীর্ষ নেতা লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা হলেও না।
এবং ইন্ডিয়া জোটের ওপর যে মানুষের ভরসা রাখার কারণ নেই, তার একটা কারণ যাত্রাতেই স্পষ্ট। এই প্রথম কোনও রাজ্যে কংগ্রেসের ন্যায় যাত্রা ঢুকল, যেখানে জোটের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দল রয়েছে। তৃণমূল এবং সিপিএম। একটি দল আবার ক্ষমতায়। এর আগে যে রাজ্যগুলো দিয়ে যাত্রা এসেছে, একটাতেও এই ছবি ছিল না। মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, অসম– কোনও জায়গাতেই না। তবু এই রাজ্যে বিশেষ গুরুত্ব পেল না রাগার যাত্রা। তৃণমূল তো সমস্যার কাঁটাই ফেলে রেখেছিল পুরো পথে। সিপিএমের জীবেশ সরকার বুড়ি ছোঁয়ার মতো উত্তরবঙ্গের কিছু জায়গায় ছিলেন, সব জায়গায় নয়। মুর্শিদাবাদে ‘সখা’ অধীরের ভোট পাওয়ার ছক রয়েছে, তাই সেখানে সেলিম-সুজনরা হাজির। সিপিএমের এই মনোভাবও চূড়ান্ত হাস্যকর।
আসলে তৃণমূল বা সিপিএম, সবারই ভোট হারানোর ভয়। বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতকে পালটে লেখা যায়, জয় করে তোর ভয় কেন তোর যায় না, হায় ভীরু ভোট হায় রে। দুটো পার্টিই নিজস্ব ভোটব্যাংক সামলানোর খেলায় ব্যস্ত ছিল। মনোভাব সেই, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্রমেদিনী। এভাবে কোনও জোট হয়?
দায় কংগ্রেসেরও। অধীর চৌধুরীর মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন নেতাকে এত বড় দায়িত্ব দিয়ে ছেড়ে রাখা। বিহারের কাটিহার থেকে মালদার হরিশ্চন্দ্রপুরে রাহুলের কনভয় আসার পর সরু পথে বাস যাচ্ছিল না। নির্ধারিত একটি গাড়িতে তোলা হয় রাহুলকে। সে গাড়িটি কাটিহার কলেজের কাছে এক বৃদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে। গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। মালদার সাংবাদিকরা যখন কাচ ভাঙা গাড়ি নিয়ে প্রশ্ন করলেন অধীরকে, লোকসভার নেতা এমন উত্তর দিলেন, যাতে মনে হবে, গাড়ির কাচ ভেঙেছে বাংলার শাসকদলের কর্মীরা। সেই খবরই ছড়িয়ে গেল দেশে। প্রশ্ন হল, অধীর কী চান? নিজের আসন জিতলেই তাঁর কেল্লা ফতে?
রাজধানীর এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি আর একটা দিক তুলে ধরলেন, যেটা লেখার মতো, ভাবার মতো। যে ১৪ রাজ্য ঘুরে ন্যায় যাত্রা শেষ হবে, সেখানে কংগ্রেসের জোটসঙ্গী পার্টির সরকার কিন্তু মাত্র দুটো রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডে। দ্বিতীয়টায় টালমাটাল দশা। বাংলায় মমতার পার্টি যাত্রার সঙ্গে ১০ শতাংশ সহায়তা করলে কংগ্রেসের লাভ হত জাতীয় পর্যায়ে। সেটা হল না। যে পথে কংগ্রেস হাঁটছে, সেই পথে গতবার লোকসভায় ফল ছিল নিদারুণ। ৩৫৫ আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ২৩৬, কংগ্রেস ১৪। হ্যাঁ, ১৪। এখানে এমন বুড়ি ছোঁয়া মার্কা ধারণা নিয়ে বাড়তি কিছু হবে?
কংগ্রেসের লাভটা তা হলে কী হল উত্তরবঙ্গে? শিলিগুড়ির এক নেতা শোনাচ্ছিলেন, সিপিএমের কিছু পুরোনো কর্মীকে দেখা গিয়েছে যাত্রায়। এমনিতে যাঁদের ভোট পড়ে নোটায়। অনেক মহিলাও এসেছেন দলবেঁধে। কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে, তেরঙায় সেজে অনেকে দীর্ঘসময় দৌড়ে গিয়েছেন রাহুলের গাড়ির পাশাপাশি। এই ভোটে হয়তো লাভ হবে না। পরের ভোটে লাভের ফসল সামান্য হলেও উঠবে।
অধীরের মতো দূরদৃষ্টিহীন নেতা যে পার্টির রাজ্যের মাথা, সেখানে এটুকুই ব্যাপক লাভ।