- অংশুমান কর
বাংলাদেশে ৬ জন মানুষ কথা বলেন একটি ভাষায়। ভাষাটির নাম রেংমিটচা। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে বাস করেন ম্রো জনগোষ্ঠীর একটি গোত্রের এই ৬ জন মানুষ। এঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই ভাষাটি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আর মাত্র কয়েকটা দিন দূরে। বাঙালিদের কাছে ফেব্রুয়ারি মাস হল ভাষার মাস। সেই মাসটিতেই যদি এহেন সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে চর্চিত হয়, তাহলে শঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে বৈকি!
রেংমিটচা ভাষাটির অবলুপ্তির দিকে ঢলে পড়া অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়। প্রায় প্রতিদিনই বিপন্ন হচ্ছে পৃথিবীর কোনও না কোনও ভাষা। হারিয়েও যাচ্ছে একাধিক ভাষা, প্রায় রোজই। ভাষার বিপন্নতা ও মৃত্যু নিয়ে কথা হচ্ছিল হায়দরাবাদ লিটারারি ফেস্টে। গত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে। উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন আর কেউ নন প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ও পণ্ডিত গণেশ ডেভি, ভারতবর্ষের বিপন্ন ভাষাগুলিকে রক্ষা করার জন্য যাঁর কর্মকাণ্ড সুবিদিত।
ডেভি বলছিলেন যে, পৃথিবীর একাধিক ভাষা অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং বহু ভাষা অবলুপ্ত হওয়ার বিপদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে একথা সত্য। কিন্তু মনে করার কোনও কারণ নেই অবলুপ্তির খাঁড়া যে সমস্ত ভাষার গর্দানের ওপর ঝুলছে না, সেই ভাষাগুলি বেশ নিরাপদ আছে। তিনি বলছিলেন পৃথিবী এমন একটি সন্ধিক্ষণে এসে আজ দাঁড়িয়েছে যে, প্রায় সমস্ত ভাষাই বিপন্ন। ভাষাতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকেরা বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এইরকম একটি সংকট তৈরি হয়েছিল সাত থেকে আট হাজার বছর আগে যখন মানুষ বীজ খুঁজে পেয়েছিল, শিখে নিয়েছিল চাষাবাদ।
জীবনধারণের জন্য গাছের ফলমূল আর শিকারের ওপর নির্ভরশীল মানুষ যাযাবর জীবন ছেড়ে থিতু হতে চাইছিল একটি জায়গায়, কর্ষণ করতে চাইছিল ভূমি। একাধিক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ এর ফলে নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে এবং পৃথিবীর ভাষা বৈচিত্র্যের অনেকখানিই বিলুপ্ত হয়। সেই রকম একটি সংকটের সামনে এসে আজ আবার দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্মিত ভাষা আজ পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কর্মকাণ্ডকে একসুরে বাঁধতে চাইছে। বিপন্নতার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাই পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষাই। ব্যবহারিক এবং প্রয়োগগত যেসমস্ত সূক্ষ্মতা একটি ভাষার চরিত্র নির্মাণ করে, সেই সমস্ত সূক্ষ্মতাই চিরকালীন অবলুপ্তির পথে যাওয়ার ভয়ংকর সুড়ঙ্গমুখে আজ দাঁড়িয়ে। আগামীতে তাই একটি ভাষার শরীর নয়, ব্যবহার্য হতে পারে ভাষাটির কঙ্কাল।
ভারতবর্ষের চিত্রটা এক্ষেত্রে ঠিক কীরকম? এ দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষার একীকরণের চেষ্টার দোসর হয়েছে কেন্দ্র সরকারের নানাবিধ সিদ্ধান্ত। এই প্রথম ২০২১ সালে যে জনগণনা হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। আদৌ হবে কি না কেউ জানে না। এর ফলে, এই দশকটিতে ভারতবর্ষে ঠিক কতগুলি ভাষায় কথা বলছেন ভারতীয়রা তা জানার আর কোনও উপায়ই থাকছে না। বোঝা যাবে না কোন ভাষা কতখানি বিপন্ন, বিলুপ্তই বা হয়ে যাচ্ছে কোন কোন ভাষা। ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসিও সংস্কৃত ভাষাজাত ভাষাগুলির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। পূর্ণোদ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে দেশজুড়ে জাতীয় শিক্ষানীতির প্রয়োগ শুরু হয়েছে। তাই শঙ্কা জাগে, সংস্কৃতর ছায়া নেই যে ভাষাগুলির ওপর, কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ?
একটি ভাষার প্রাণরক্ষা কী করে করা যায় তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। গণেশ ডেভি হায়দরাবাদ লিটারারি ফেস্টিভালে বলছিলেন যে, কর্মসংস্থানের সঙ্গে ভাষাকে রক্ষা করার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। দক্ষিণের উপকূলবর্তী একটি ছোট্ট জনগোষ্ঠী কীভাবে সমুদ্রের যে অংশে তারা মাছ ধরতেন সেই অংশটির দখলদারি একটি কর্পোরেট সংস্থার হাতে চলে যাওয়ায় বাধ্য হন ওডিশার উপকূলে চলে যেতে এবং এর ফলে হারিয়ে ফেলেন নিজেদের ভাষা- তিনি বলছিলেন সেকথা। অনেক সময় আমরা এমন একটি কথা বলে থাকি যে, শিক্ষায়তনের শ্রেণিকক্ষে নয়, ভাষা বেঁচে থাকে রাস্তায়। কথাটা হয়তো ভুল নয়। কিন্তু রাস্তার দখলদারিই যদি ক্রমাগত চলে যেতে থাকে কর্পোরেট সংস্থার হাতে, তখন কী উপায়?
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ডেভি আক্ষেপ করছিলেন, ভারতে কেন্দ্র সরকার কখনোই ভাষাকে কেন্দ্রে রেখে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বা কর্মসংস্থানের নীতি নিরূপণ করেনি। নিরূপণ করেনি অর্থনৈতিক নীতিও। বলছিলেন যে, একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি না বাঁচলে ভাষার বেঁচে থাকাও বেশ কঠিন। প্রশ্ন জাগে, সত্যিই তো, আমাদের দেশের কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলি ভাষাকে বাঁচানোর জন্য সংস্কৃতিকে কেন্দ্রে রেখে দীর্ঘমেয়াদি, সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কেন গ্রহণ করছে না? সংস্কৃতির জন্য বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে দেশ বা রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কোনও সংযোগই সাধারণত থাকে না। একটি দুটি ব্যতিক্রমকে এক্ষেত্রে নিয়মের প্রমাণ হিসেবেই ধরতে হবে।
আমাদের রাজ্যেও তো চিত্রটা কমবেশি একই রকম। রাজ্যে রয়েছে সংস্কৃতি এবং ভাষাচর্চার জন্য একাধিক আকাদেমি। কিন্তু এইসব আকাদেমি কর্মসংস্থানের প্রশ্নটির সঙ্গে আদৌ সংযুক্ত কি? এইসব আকাদেমির অধিকাংশেরই কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কেবলমাত্র কতগুলি উৎসবের আয়োজন করা। জানতে ইচ্ছে করে যে, এই আকাদেমিগুলো সংস্কৃতি এবং ভাষাচর্চার সঙ্গে কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তার যোগটিকে দাগিয়ে দিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে কোনও সুচিন্তিত প্রকল্প আজ পর্যন্ত জমা করেছে কি? রাজ্য সরকারকে একটি বিষয়ে অবশ্য সাধুবাদ জানাতেই হয়। আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরেই সংগীত, নাটক চিত্রকলার পাঠ দেওয়া হত। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে আবৃত্তির মতো আরও কয়েকটি পারফরমিং আর্টসের বিষয়কে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রথাগত পাঠদানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্কুলের শিক্ষাক্রমেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতিচর্চাকে।
কিন্তু এই সমস্ত পাঠক্রমের সমাপনান্তে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের কী উপায় হবে? এই কর্মসংস্থানকেও তো ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে খোলা বাজারের হাতে। একজন শিক্ষার্থীকে সংস্কৃতিচর্চার একটি ডিগ্রি দিয়ে খোলা বাজারে ছেড়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, তোমার চাকরির কোনও সংস্থান সরকার করবে না, মাচায় উঠে অনুষ্ঠান করে শাকান্ন সংগ্রহ করে নাও। ব্যাপারটা অনেকটা ওই চপ শিল্পের মতোই।
ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি বাঙালির আবেগ সুবিদিত। কিন্তু সত্যিই বলতে কী, শুকনো আবেগে চিঁড়ে ভেজার দিন দ্রুত অন্তর্হিত হচ্ছে। সংস্কৃতি এবং ভাষাচর্চার সঙ্গে দেশ এবং রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও কর্মসংস্থানের সংযোগস্থাপন না করা গেলে হিন্দি এবং ইংরেজি ব্যতীত আমাদের দেশের কোনও ভাষার ভবিষ্যতই সেইভাবে সুরক্ষিত নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে এই শঙ্কার কথাটি উচ্চারণ করার একটিই অভিপ্রায়। সেটি হল সমস্যাটির প্রতি সরকার বাহাদুরগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ। অবশ্য এমনটাও হতেই পারে যে, সব সরকার বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক সচেতন। কিন্তু, ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে পুঁজিপতি এবং কর্পোরেটের স্বার্থ রক্ষাকেই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাই ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি আবেগকে ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে প্রয়োজনমতো তাঁরা উসকে দেন, কিন্তু সংস্কৃতি ও ভাষার প্রাণরক্ষার জন্য কাজের কাজটি করেন না।
(লেখক সাহিত্যিক ও অধ্যাপক)