দীপ্তিমান মুখোপাধ্যায়, কলকাতা : বিভাগীয় তদন্তেই শেষ নয়, ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের ৩৫ জন আধিকারিকের পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি আপাতত স্থগিত থাকবে। অনৈতিকভাবে জমির চরিত্র বদলের অভিযোগে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে বলে নবান্নের নির্দেশ।
তবে শুধু ভূমি দপ্তরের আধিকারিকরা নয়, এই তদন্তে সরকারের নজর পড়েছে কয়েকজন জমি মাফিয়ার পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক নেতার দিকেও। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এঁরা সক্রিয়। নেতারা মূলত তৃণমূলের। মাঝারি মাপের নেতা তাঁরা। এজন্য সরকারি তদন্তের পাশাপাশি তৃণমূল দলীয় স্তরে অনুসন্ধান শুরু করেছে। চিকিৎসার পর আমেরিকা থেকে ফিরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের কয়েকজন নেতাকে ডেকে পাঠাতে পারেন।
উত্তরবঙ্গে জমি নিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে মানছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, এই চক্র প্রকাশ্যে আসুক ও তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিক। পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনের কারণে ব্যস্ত থাকায় আমি মন্ত্রীসভার গত বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারিনি। তবে শুনেছি। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী নিজে তদারকি করছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে দেখছেন বলে আমাদের আর কিছু বলার থাকে না।’
ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর, রাজনৈতিক নেতা ও মাফিয়াদের যৌথ উদ্যোগে উত্তরবঙ্গে এই কেলেঙ্কারিতে বেআইনিভাবে অন্তত ৩৫ হাজার একর জমির চরিত্র বদল হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে নবান্নের কাছে রিপোর্ট পৌঁছেছে। তার ভিত্তিতে এই অনৈতিক কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে ভূমি দপ্তরের ৩৫ জন আধিকারিকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। তাঁদের পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি আটকে দিতে অর্থ দপ্তর নির্দেশ দিয়েছে। ওই আধিকারিকদের বদলি করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার।
নবান্ন সূত্রে খবর, গত প্রায় ৩০ বছর ধরে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় জমির চরিত্র বদল করে বিক্রির এই অসাধু কারবার চলছিল। এ নিয়ে আগে তদন্ত হলেও রহস্যজনক কারণে তার অগ্রগতি বিশেষ হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ কর্মসূচিতে অভিযোগ আসায় বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে পড়ে। তারপর কড়া পদক্ষেপ শুরু করে নবান্ন। যদিও বিরোধীদের দাবি, সর্ষের মধ্যে ভূত আছে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর এখন খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। ফলে তিনি কিছুই জানতেন না বলে মানছে না বিরোধীরা।
রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা প্রবীণ সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর শিলিগুড়ি ও সংলগ্ন এলাকায় জমি কারবারিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সব খবর থাকে। এখন বিষয়টি সামনে আসায় তিনি লোক দেখানো তদন্ত করছেন। তাঁর দলের নেতারাই এই দুর্নীতিতে যুক্ত।’ শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শংকর ঘোষ বলেন, ‘রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে এই দুর্নীতি হয়েছে। আমি বিধানসভায় এ নিয়ে প্রশ্ন করলেও রাজ্য সরকার তার উত্তর দেয়নি।’
প্রশাসনিক তদন্তের পাশাপাশি এই ব্যাপক জমি কেলেঙ্কারি সম্পর্কে খোঁজখবর করছে রাজ্যের অ্যান্টি করাপশন সেল। ওই সেলের ৫ জন আধিকারিককে এই তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেলের অনুসন্ধানে উত্তরবঙ্গের জমি দুর্নীতিতে বিভিন্ন জেলায় মাঝারি ও নীচুতলার কয়েকজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিকদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের হদিস পাওয়া গিয়েছে। জমির চরিত্র বদল তো বটেই, এই চক্রের সৌজন্যে নদীর জমিও বিক্রি হয়ে গিয়েছে বলে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন।
তবে শুধু মাঝারি বা নীচুতলার নেতা নয়, তাঁদের মাথার ওপর জেলা স্তরের কয়েকজন নেতার হাত রয়েছে বলেও তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। মনে করা হচ্ছে, সেই কারণেই প্রশাসন এতদিন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস পায়নি।