গৌরহরি দাস, কোচবিহার : খেত থেকে বেত তুলে, তার ছিলকা বের করে পাটি বুনে হাটে বিক্রি করেন কোচবিহার-১ ব্লকের ঘুঘুমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের গাঙ্গালেরকুঠি, পানিশালা গ্রাম পঞ্চায়েতের পশ্চিম ধলুয়াবাড়ি, ধলুয়াবাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। তা দিয়েই তাঁদের সংসার চলে বছরভর। পঞ্চায়েত নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায় চলে আসায় চারদিক নির্বাচনি ব্যানার-ফেস্টুনে ছয়লাপ। কিন্তু এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দার তাতে তেমন উত্সাহ নেই। তাঁদের কথায়, নির্বাচনের দিন অবশ্যই ভোট দেব। কে জিতবেন, তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। নির্বাচন নিয়ে মেতে থাকলে আমাদের চলবে না। কোনও পার্টি তো পেটের ভাত জোগাবে না। পেটের ভাত জোগাবে পাটি। তাই সেই কাজটা করতেই হবে।
কোচবিহার-১ ব্লকের ধলুয়াবাড়ি, গাঙ্গালেরকুঠির মতো এলাকাগুলি পাটির জন্য বিখ্যাত। এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পাটি বুনেই সংসার চালান। এলাকায় প্রচুর বেতের বাগান রয়েছে। পাটিশিল্পীরা সেই বেত কেটে বিশেষ পদ্ধতিতে দা দিয়ে তার থেকে ছিলকা বের করেন। সেই ছিলকা দিয়ে নিপুণ হাতে তাঁরা পাটি বোনেন। পাটি তৈরিতে পরিবারের প্রায় সকলেই হাত লাগান।
এখানকার পাটির দেশজোড়া নাম রয়েছে। বেতের উপরের অংশ দিয়ে বোনা শীতলপাটির খ্যাতি তো সারা পৃথিবীতে। দেশের বাইরে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন জায়গায় এই পাটি যায়। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত একেবারে দোরগোড়ায় চলে এলেও এলাকার বাসিন্দাদের তাতে তেমন উত্সাহ নেই। তাঁরা মেতে রয়েছেন তাঁদের কাজ নিয়েই। সোমবার গ্রামগুলিতে গিয়ে দেখা গেল, এলাকার রাস্তাঘাট নির্বাচনি ব্যানার-পোস্টারে ছয়লাপ হয়ে রয়েছে। কিন্তু মিটিং-মিছিল তেমন নেই। এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে পাটি বোনার কাজ জোরকদমে চলছে। নির্বাচনের মুখে পশ্চিম ধলুয়াবাড়িতে বিজেপি শিবির করেছে। সেখানে গিয়ে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা শোনা গেল না। এমনকি পার্টির কর্মীদের দেখা মিলল না। বরং তাঁবুর ভিতরে বসে এক ব্যক্তি মন দিয়ে পাটি বোনার জন্য বেতের ছিলকা তুলছেন। গৌতম চন্দ নামে ওই ব্যক্তির সহজ স্বীকারোক্তি, ‘ভোটের দিন ভোট দেব। তাতে যে ভালো প্রার্থী সে জিতবে। কিন্তু আমাদের কাজ হচ্ছে পাটি বোনা। এটা না করলে তো পেটে ভাত জুটবে না।’
ধলুয়াবাড়িতে পাটির বড় বাজারও রয়েছে। বিভিন্ন জায়গার থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে পাটি কিনে নিয়ে যান। সোম ও বৃহস্পতিবার দু’দিন পাটির হাট বসে। সোমবার পাটি বুনতে বুনতে এলাকার বাসিন্দা রত্না পাল আর ছায়া চন্দ দুজনেই বললেন, ভোটের দিন ভোট দেব ওই পর্যন্তই। আমাদের এখানে পার্টি নিয়ে কারও বিশেষ উৎসাহ নেই। আমাদের সব উৎসাহ পাটিতেই।’ গাঙ্গালেরকুঠির অশীতিপর পরেশ ভৌমিকের গলাতেও একই সুর। বলেন, ‘ভোট দেব। কিন্তু ভোট নিয়ে পড়ে থাকলে তো চলবে না।’
‘রাজনৈতিক অশান্তি’ কথাটার সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নন ধলুয়াবাড়ির বাসিন্দারা। একমাত্র পানিগ্রামে দু’একবার খুচরো গোলমাল হলেও এলাকার মানুষ চান না তাঁদের এখানে কোনও অশান্তি হোক। কারণ তাতে তাঁদের কাজ আর ব্যবসার ক্ষতি, এটা হাড়েহাড়ে বোঝেন এলাকার সকলে। আর সেই মন্ত্রেই কোচবিহারের বাদবাকি জায়গার থেকে একেবারেই আলাদা ধলুয়াবাড়ি।