প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান: সম্রাট সেলিম খানের দুর্গ স্থান হিসাবেই পরিচিত সেলিমাবাদ গ্রাম। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের এই গ্রামের রথে ব্রাত্য থাকেন প্রভু জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবী। রথের পর দিন এখানকার ভক্তদের টানা রথে চড়ে গ্রামে ঘোরেন রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল। ব্যতিক্রমী হলেও, এই মাহাত্মকেই আঁকড়ে থাকতে চান সেলিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দারা। হিন্দু দেবদেবীর কোনও পুজোই পঞ্জিকা উল্লিখিত দিনে হয় না সেলিমাবাদ গ্রামে। সবই হয় পঞ্জিকায় উল্লেখ থাকা দিনের পর দিন। সেই রীতি মেনেই মঙ্গলবারের পরিবর্তে বুধবার সেলিমাবাদ গ্রামে গোঁসাই মতে হবে রথযাত্রার পুজো পাঠ। তাও আবার প্রভু জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পুজো পাঠ নয়। ওই দিন পুজিত হবেন শুধুমাত্র রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল।
সেলিমাবাদ গ্রামটি পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর-১ পঞ্চায়েত এলাকার একটি প্রাচীন জনপদ। কথিত আছে, এককালে সম্রাট সেলিম খান এই গ্রামে আস্তানা গেড়েছিলেন। সেই থেকে গ্রামটি সেলিমাবাদ নামে পরিচিতি পায়। হিন্দু ও মুসলিম সহ বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ এই গ্রামে বসবাস করেন। গ্রামের মাঝামাঝি একটি জায়গায় রয়েছে ’বাল গোপাল জীউ’ এর প্রাচীন মন্দির। সেই মন্দিরেই রথযাত্রা সহ হিন্দুদের অন্য সকল আরাধ্য দেবদেবীর পুজোপাঠ হয়। সম্রাট সেলিম খান বহুকাল পূর্বে আরামবাগ থেকে বর্ধমানের দিকে যাচ্ছিলেন। দামোদরের বাঁধ ধরে যাওয়ার সময়ে পথে তাঁদের গ্রামের ’বাল গোপাল জীউর’ মন্দির সংলগ্ন জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে তিনি আশ্রয় নেন। পরে পাকাপাকি ভাবে তিনি সেখানেই তাঁর ’আস্তানা’ গড়ে তোলেন। সেলিম খানের নাম অনুসারে পরবর্তী কালে গ্রামটি ’সেলিমাবাদ’ গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক শক্তিপদ সাঁতরা জানান, ’১৯১৮ সালের পরবর্তী কোনও এক সময়ে সেলিমাবাদ গ্রামে এসে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য। বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য এই গ্রামে নিজের বাড়ির সামনেই মন্দির গড়ে তোলেন। সেই মন্দিরেই তিনি রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল ঠাকুরের বিগ্রহের পুজোপাঠ শুরু করেন। তিথি অনুয়ায়ী গোটা দেশ জুড়ে হওয়া রথ উৎসবের পরের দিন সেলিমাবাদ গ্রামের রথযাত্রা উৎসবের সূচনা দ্বীজবরদাস বৈরাগ্যই করেছিলেন’। সেই প্রথা মেনে আজও রথের পর দিন রথের পুজোপাঠ সম্পন্ন করে আসছেন সেলিমাবাদের ’বাল গোপাল জীউ, সেবা সমিতি। পুরীর রথে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর বিগ্রহের পুজোপাঠ হয়। কিন্তু তাঁদের গ্রামে রথের পরদিন বাল গোপাল জীউ’ মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের প্রস্তর মূর্তি এবং অষ্টধাতুর গোপাল মূর্তির পুজো হয়। তারপর ভক্তদের প্রসাদ ও ভোগ বিতরণ শেষে বিকালে কাঠের তৈরি প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার রথে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি ও গোপাল মূর্তি চাপিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে নিয়ে যাওয়া হয় দামোদরের ধারের মাসির বাড়িতে। শতাধিক বছর ধরে এভাবেই ব্যতিক্রমী রথযাত্রা উৎসব পালন করে আসছেন সেলিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দারা।