রূপায়ণ ভট্টাচার্য
রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন প্রশ্ন তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘সীতা ছাড়া রাম হয় না। ওরা সীতার নাম নেয় না কেন?’
ইদানীং মমতার অধিকাংশ প্রশ্নেই অনর্থক মাখা থাকে রাজনীতির চচ্চড়ি। অন্য পার্টির নেতাদের মতোই। তবে এই প্রশ্নটা ভাবায় রীতিমতো।
ভারতীয়রা সত্যিই কি সীতাকে গুরুত্ব দেন না? রাম মন্দিরের উদ্বোধনের দিন খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, দেশজুড়ে শুধু সীতার একক মন্দির ক’টা। তাতে হতাশই হতে হল।
রামায়ণের গল্পে অনেক বেশি শ্রদ্ধা জাগান সীতাই। দুর্বৃত্তবেষ্টিত বনে তিনি ১৪ বছর প্রায় একা থাকার সাহস দেখাতেন। শ্বশুর-শাশুড়ির ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েও প্রশ্ন তোলেননি, নইলে তো রামায়ণই হত না। ভিনদেশে বন্দি হিসেবে থাকার যন্ত্রণা সহ্য করেছেন বহুদিন। অগ্নিপরীক্ষা দিতে কুণ্ঠিত হননি রামের অবাক আবদারের পর। হলকর্ষণের সময় তাঁকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বলে তাঁর জন্মবৃত্তান্তেই প্রশ্ন তুলে রেখেছেন রামায়ণ রচয়িতা। সন্তানদের বড় করেছেন একা, অনেক কষ্ট করে।
সেই মূর্তিমতী শ্রদ্ধা উপস্থিতা সীতার জন্য ভারতে কয়টা মন্দির রয়েছে? হাতেগোনা কয়েকটা রাজ্যে। এত রাম-সীতার বন্দনা, সেখানে সীতার নিজস্বতাকেই ভারতবাসী গুরুত্ব দেয়নি। রাম মন্দিরে গুরুত্বহীন হয়ে রয়েছেন কোথাও, স্রেফ রাজার রানি হয়ে। শুধু সীতার মন্দির বললে সবচেয়ে পরিচিত হরিয়ানার কার্নালের সীতামাই মন্দির। তারপরে আসবে মহারাষ্ট্রের নাসিকের সীতা গুফা, কেরলের ওয়েনাডের সীতা দেবী মন্দির, বিহারের সীতামারির পুনাউরা জানকী মন্দির, উত্তরপ্রদেশের ভাদোহির সীতা সমাধিস্থল, বিজনোরের সীতা সমাধি মন্দির, উত্তরাখণ্ডের নৈনিতালের সীতাবাণী মন্দির এবং অযোধ্যারই কাছে সীতা কা রসই–সীতার রান্নাঘর।
এসব মন্দিরে যাওয়ার জন্য আকুলিবিকুলি কি কোনওদিন দেখা গিয়েছে তথাকথিত রামভক্তদের? না।
তার মানে কি পুরোনো চিরকালের প্রশ্ন ও তত্ত্বে আমরা ফিরে যাব? নারী বলেই উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন সীতা। দেশজুড়ে রামের প্রভাব যতটা বেড়েছে, ততটাই সীতার প্রভাব বাড়া উচিত ছিল। বাড়েনি তো। তেলুগু সিনেমায় শোভন বাবু নামে এক অভিনেতা ছিলেন। এনটি রামা রাওয়ের মতো প্রচুর ছবিতে রামের অভিনয় করেছেন। লোকে সীতার অভিনেত্রীকে ভুলে গিয়েছে, রামকে ভোলেনি। সীতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনেকে। অনীতা গুহ বা দীপিকা চিকলিয়া বাদে কেউ কি মনে দাগ কাটতে পেরেছেন? মনে হয় না। ওদিকে রাম হিসেবে হারিয়ে যাওয়া মহিপাল, আশিস কুমার বা অরুণ গোভিলকেও মনে রেখেছে লোকে। গ্রামীণ চব্বিশ প্রহরে রাধা যেমন গুরুত্ব পান গান-কীর্তনে, সীতা তেমন পান কি? তাঁর কপালে জোটে শুধু ‘জনমদুখিনী’ ট্যাগ।
কয়েকটা মন্দিরের কথা বলি। মধ্যপ্রদেশের ওরচায় রামরাজা, তেলেঙ্গানার ভদ্রাচলমে রামচন্দ্রস্বামী, তামিলনাডুর কুম্ভকোনমে রামস্বামী, মহারাষ্ট্রের নাসিকে কলারাম, কেরলের ত্রিশূরে ত্রিপয়ার, ভুবনেশ্বরে রাম মন্দির, কর্ণাটকের হিরেমাগালুরে কোডন্ডারামা, অমৃতসরের রাম তীরথ, জম্মুর রঘুনাথ। খেয়াল করে দেখুন, এখন রামনবমী বা রাম মন্দির নিয়ে যে গোবলয়ে হিস্টিরিয়ার মতো হয়েছে, সেইসব জায়গায় কিন্তু তেমন রাম মন্দির প্রতিষ্ঠাই হয়নি অতীতে। যেসব জায়গায় রাম মন্দির উপস্থিত, সেখানে বরং ওই ধরনের গণহিস্টিরিয়া দেখা যায়নি। বাংলায় শ্রীরামপুর, শেওড়াফুলি, চুঁচুড়া, কৃষ্ণনগর, মাটিয়ারি, করিমপুর, নবদ্বীপ, লালগোলায় রাম মন্দির রয়েছে। শ্রীরামপুর বাদে কোথাও রামসীতা মন্দির বলা হয় না সম্ভবত।
পুরো ভারতের কথা ভাবলে আবার রামের চেয়ে হনুমান ভজনার প্রচলনই দেশজুড়ে বেশি। পবন-পুত্রের হাত ধরে বন্দনা পান রাম। রাজধানী নয়াদিল্লির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কনাট প্লেস অঞ্চলে যে বিশাল হনুমান মন্দির, তা দিন-দিন আরও বেড়ে চলেছে আয়তনে।
আসল সার কথা হল, রামনাম বহু যুগ ধরেই ভারতীয়দের মনে গেঁথে। এখনকার মতো রাজনৈতিক টিপ্পনী দিয়ে নয়। আজও নয়াদিল্লির রাস্তায় অনেকে পরিচিত কাউকে দেখলে স্বতঃস্ফূর্ত বলে ওঠেন, ‘রাম রামজি’। কমিউনিস্ট হলেও বলতে ঠেকে না। উত্তর ভারতে এটাই রেওয়াজ। পুরোনো আমলের টেলিফোন ডিরেক্টরি আজও থাকলে দেখা যেতে পারে, কত লোকের নাম শুরু হয়েছিল রাম দিয়ে। ধর্ম বা রাজনীতি সেই ‘রাম’ শব্দটিকে ছুঁতে পারেনি। এখন যা নিয়ম হয়ে উঠছে ক্রমশ। রাম সম্পত্তি হয়ে যাচ্ছে শুধু বিজেপির।
বিজেপি এমন জায়গাটা ধরেছে, তাতে লোকসভা ভোটে উত্তরভারত মুঠোয় আসাও অনিবার্য। দিনতিনেক আগে শিলিগুড়ির শিবমন্দির অঞ্চলের এক ভেতো বাঙালিকে দেখি টুপি-মাফলার থেকে মোজা-জুতো গেরুয়া রংয়ে ঢেকে, বুকে রামের ফোটোগ্রাফ ঝুলিয়ে বাগডোগরা বিমানবন্দরে চ্যাঁচাচ্ছেন–জয় শ্রীরাম। কিছুক্ষণ অন্তর। লোকে তাকিয়ে দেখছে, হাসছে। তাঁর তাপউত্তাপ নেই। সজোরে অবিরাম লালমোহনবাবু স্টাইলে হিন্দিতে বলে যাচ্ছেন, ‘অযোধ্যা যাচ্ছি প্লেনে।’ রামের নবউত্থানের সঙ্গী।
প্রশ্ন রইল, রামের এই নবউত্থানে সীতার লাভটা কী হল? বহু শতাব্দী আগে সীতাকে যেভাবে পুরুষতন্ত্রের জ্বলন্ত শিকার হতে হয়েছিল, আজও তো তাই চলছে। রাম জন্মভূমির মন্দির উদ্বোধনে প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মুর ভূমিকা রইল না, ঠিক যেমন ছিল না নতুন সংসদের উদ্বোধনে। নয়াদিল্লি বা কলকাতায় কোনও নব্য নারী মন্ত্রীর বড় উত্থান দেখা যায়নি। সক্রিয়তা দেখিয়েও নির্মলা সীতারামন বা চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যেমন আড়ালে, লকেট চট্টোপাধ্যায়, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, দেবশ্রী চৌধুরী বা দীপা দাশমুন্সিও তাঁদের রাজ্য পার্টিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। শিলিগুড়িতে পাপিয়া ঘোষ, শিখা চট্টোপাধ্যায়, কোচবিহারে মালতী রাভা রায়, জলপাইগুড়ির মহুয়া গোপ, মালদার মৌসম নুররা কার্যত গুরুত্বহীন পুরুষ নেতাদের দাপটে। যেন এটাই নিয়তি মেনে নিয়েছেন। মমতা বা সুকান্তও গুরুত্ব দেন না।
দিনকয়েক আগে কিছু জেলায় পঞ্চায়েতের প্রধান মহিলাদের নিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প করল রাজ্য প্রশাসন। সেখানে প্রধানদের সব স্বামীকেও ডাকা হয়েছিল। কেন? না, স্ত্রীদের সবসময় নাকি চালাচ্ছেন স্বামীরাই। তা বন্ধ করতে শিবির। এটা শুধু বাংলায় নয়, চলে দেশজুড়েই। স্বামীদের কি প্রশাসন ওইভাবে ডাকতে পারে, প্রশ্নটা উঠতে পারত। তা কোনও পুরুষ তোলেননি। ধরে নিয়েছেন, পঞ্চায়েত প্রধান স্ত্রীকে আমারই চালানোর কথা। আমিই তো ভাই বস।
সীতাদের কথা কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবে না এখনও। অযোধ্যা বলুন বা কোনও গ্রামীণ ভারতের কথা বলুন–পুরুষতন্ত্রের অভিধানে সীতারা আজও ব্রাত্য।