অনির্বাণ চক্রবর্তী, কালিয়াগঞ্জ : রাত পোহালেই ১৪ প্রদীপের আলোয় রাঙিয়ে উঠবে প্রত্যেকের বাড়ি। আর একদিন পর সারা দেশের সঙ্গে আলোর বন্যায় ভাসবে কালিয়াগঞ্জ। কিন্তু ঠিক উলটো চিত্রের দেখা মিলবে নির্যাতিতা নাবালিকার বাড়ি এবং পুলিশের গুলিতে নিহত রাধিকাপুরের বাসিন্দা মৃত্যুঞ্জয় বর্মনের বাড়িতে।
মাস কয়েক আগে এই দুই পরিবারেই নিভে গিয়েছে প্রদীপের আলো। তবে, দুই পরিবারের লোকেরাই ওদের সমাধিস্থলে প্রদীপ জ্বালিয়ে আসবেন। কান্নাভেজা গলায় মৃত নাবালিকার মা জানান, ‘কালীপুজোয় মেয়ে আতশবাজি ফোটাতে খুব ভালোবাসত। তাই তুবড়ি, তারাবাতি, চরকি, ফুলঝুরি দোকান থেকে আনতে বলেছি। শ্যামাপুজোর দিন ওর সমাধিস্থলে ওগুলো রেখে আসব।’
ছয় মাস আগে এক রাজবংশী নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল কালিয়াগঞ্জ। দিনের আলোয় সুবিচারের আশায় বিক্ষোভরত সাধারণ মানুষের সামনে থেকে নাবালিকার মৃতদেহ টেনেহিঁচড়ে উদ্ধারের ঘটনায় দেশজুড়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মানবিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। নাবালিকা ধর্ষণ কাণ্ডের দিনকয়েক বাদে জনসাধারণের ক্ষোভ আছড়ে পড়েছিল কালিয়াগঞ্জ থানায়। ভাঙচুরের পাশাপাশি থানার পুলিশ আবাসনে অগ্নিসংযোগ, পুলিশকর্মীদের মারধরের ঘটনায় কার্যত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল কালিয়াগঞ্জ। থানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছিল স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। সে সময় রাতের অন্ধকারে রাধিকাপুর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার চাঁদগাঁওয়ের বিজেপির পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য বিষ্ণু বর্মনকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে তাঁর জ্যাঠতুতো ভাই মৃত্যুঞ্জয় বর্মনকে সরাসরি বুকে গুলি করে মারার অভিযোগ ওঠে কালিয়াগঞ্জ থানার কর্মরত এক এএসআই মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে।
জীবনের এক প্রান্তে পৌঁছে আজও এভাবে ছোটছেলের মৃত্যু কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না মৃত্যুঞ্জয়ের অসুস্থ বাবা রবীন্দ্রনাথ বর্মন। মায়েরও একই দশা। স্ত্রী, সন্তানের মুখ চেয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের তরফে জানা গেল, যে দীপের আলোয় আলোকিত হয়েছিল চাঁদগাঁওয়ের এই বর্মন পরিবার, আজ সেই মৃত্যুঞ্জয় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। তাই দীপাবলি উত্সবে আলোর রোশনাইয়ের ছিটেফোঁটাও এবছর এই বাড়িতে পড়বে না। জ্বলবে না ১৪ প্রদীপ। নিয়মে বাঁধা ডোরে শনিবার দুপুরে পাতে পড়বে না ১৪ শাকও। মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রী গৌরীর কথায়, ‘ওর সমাধিস্থলে মৃত্যুর ন্যায়বিচারের আশায় প্রদীপ জ্বালিয়ে আসব।’
মৃত্যুঞ্জয়ের সম্পর্কে এক আত্মীয় বিষ্ণু বর্মন জানান, ‘ভাইয়ের আত্মার শান্তিকামনায় পাড়ার প্রতিটি বাড়ি থেকেই দীপাবলিতে ভাইয়ের সমাধিস্থলে প্রদীপ জ্বালানো হবে। পাড়ার অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে দীপাঞ্জনও আতশবাজি ফোটাবে। ওকে বাবার অভাব আমরা কোনওদিন বুঝতে দেব না।’
বাড়ির উঠোনে ছোটাছুটি করছিল মৃত্যুঞ্জয়ের ছেলে দীপাঞ্জন। কীরে কালীপুজোয় তারাবাতি জ্বালাবি না? প্রশ্ন করতেই ঘরের বারান্দার বাঁশের খুঁটি ধরে নির্লিপ্ত ছোট্ট ছেলেটির সরল উত্তর, ‘বাবা আমাকে অনেক বাজি কিনে দেবে।’