নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা : গত তিনদিনে মৃত্যুর সংখ্যা আর বাড়েনি রাজ্যে। কিন্তু ধীরে হলেও সংক্রমণের গতি ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। মুখ্যসচিব রাজীব সিনহার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মঙ্গলবারের পর আরও ১৭ জন সংক্রামিতের হদিশ মিলেছে। নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে বুধবার তিনি বলেন, আজ পাঁচজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন সুস্থ। ফলে রাজ্যে এখন করোনা পজিটিভের সংখ্যা ১৩২। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ভবনের বুলেটিনে জানানো হয়েছিল, তার আগের ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছিল ১০। সোমবারের পরিসংখ্যানে আক্রান্তের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে ১৫ বেড়েছিল। সংক্রমণের এই গতিতে এদিন উদ্বেগ ধরা পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর গলাতেও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ারই কথা। আগে ছিল পরিবারভিত্তিক সংক্রমণ। এখন এর সঙ্গে সে মিশছে, তাঁর সঙ্গে আরও একজন মিশছে। ফলে সংক্রমণটা কিছুটা এলাকাভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে।
বিরোধীরা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এদিনও তথ্য গোপনের অভিযোগ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, সংক্রমিত এবং মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সেই পরিসংখ্যান সরকার চেপে যাচ্ছে। কেন্দ্রের তরফে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মুখ্যসচিবের দেওয়া পরিসংখ্যানের অমিল রয়েছে। বুধবার সকালে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের বুলেটিনে জানানো হয়েছে, বাংলায় এখন আক্রান্তের সংখ্যা ২১৩। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩৭ জন। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসাবে বুধবার পর্যন্ত রাজ্যে করোনা পজিটিভের সংখ্যা ১৬৯ জন। এই তথ্যকে হাতিয়ার করে রাজ্য সরকারকে নিশানা করছে বিরোধীরা। বিজেপি নেতা রাহুল সিনহার বক্তব্য, তথ্য গোপন করে মুখ্যমন্ত্রী কি এমন মহত্ কাজ করছেন? বরং সঠিক পরিসংখ্যান দিলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হত।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য লকডাউনে কড়াকড়ি করার ওপর জোর দিয়েছেন। এতদিন শুধু আবেদন, অনুরোধ করলেও বুধবারই প্রথম প্রচ্ছন্নে কিছুটা সতর্ক করেছেন রাজ্যবাসীকে। কোথাও কোথাও স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। করোনায় মৃতদের দেহ দাহ করতে বাধা দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আবাসনে ডাক্তারদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, মাস্ক এখন অবশ্যই পরতে হবে। মাস্ক পরে না বেরোলে কিন্তু পুলিশ বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে। কথা না শুনলে কড়া ব্যবস্থাও নিতে পারে। সরকার ইচ্ছে করলে জেলে পুরে দিতে পারে। কিন্তু আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। মহিলাদের উদ্যোগী হয়ে স্বাস্থ্যবিধি এবং লকডাউন মান্য করার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, হোম আইসোলেশন মানে তো জেল নয়। বাড়িতে থাকুন। দরকার হলে পুলিশকে বলুন। পুলিশ বাড়িতে জিনিস পৌঁছে দেবে। দেখবেন, সংক্রমণ যেন সমষ্টিগতভাবে না বাড়ে। তাহলে এলাকায় এলাকায় সর্বনাশ হয়ে যাবে। লকডাউন কঠোরভাবে পালন করার কথা বললেও নতুন করে বেশকিছু ক্ষেত্রে এদিন ছাড় ঘোষণা করেছেন মমতা। এই ক্ষেত্রগুলির মধ্যে আছে পঞ্চায়েত, গ্রামোন্নয়ন, ছোট কারখানা, ইটভাটা ইত্যাদি রয়েছে। তিনি জানান, ১৫ শতাংশ হাজিরার ভিত্তিতে ইটভাটাগুলিতে কাজ করা যাবে। ছোট ছোট কারখানার ক্ষেত্রে প্রোটোকল মেনে উত্পাদনের জন্য আবেদন করতে হবে মুখ্যসচিবের কাছে। তিনি অনুমতি দিলে কারখানা চালু করা যাবে। পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কল্যাণকর প্রকল্প, ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, নার্সারি, প্ল্যান্টেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনুমতি দেওযার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এতে অসুবিধা কিছু হবে না। যাঁরা হাটে-বাজারে যাচ্ছেন, তাঁরা এই কাজ করলে বাঁচবেন। প্রশাসনিক স্তরে ডেপুটি সেক্রেটারি এবং তাঁর ঊর্ধ্বতন পদমর্যাদার আধিকারিকদের ২০ এপ্রিলের পর থেকে একদিন পরপর অফিস করতে হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। তাঁর বক্তব্য, স্যানিটাইজেশন, মাস্ক এবং সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে মানবিকভাবে লকডাউন কার্যকর করতে হবে। চা-বাগানে কাজ শুরু হয়েছে। সেচ, রাস্তা নির্মাণ, পিএইচই, বিল্ডিং নির্মাণ ইত্যাদিতেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় শ্রমিকদের নিয়ে ওই কাজ করতে হবে। সচল থাকবে ওয়্যার হাউসও। একশো দিনের কাজও ২০ এপ্রিলের পর থেকে শুরু করা হবে বলে তিনি জানান।
সেক্ষেত্রেও মাস্ক পরে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে হবে। মোট যে সংখ্যার শ্রমিক প্রযোজন, তার চেয়ে অর্ধেক সংখ্যার লোক দিয়ে ওই কাজ চলবে। ভিন রাজ্যে আটকে পড়া এই বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য এদিন নির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। মহারাষ্ট্রের বান্দ্রায় মঙ্গলবার যেভাবে লকডাউন ভেঙে শ্রমিকরা ভিড় করেছিলেন, তাতে উদ্বিগ্ন অনেকেই। মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি এদিন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়েছি। তিনি এই সংকটের মধ্যে কাজ করছেন। কেউ কেউ ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা কমিউনাল ভাইরাস ছড়ানোর সময় নয়। সবাইকে নিয়ে কাজ করার সময়। বান্দ্রায যাঁরা জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদেরও দোষ দেব না।
মহারাষ্ট্রে আটক পশ্চিমবঙ্গের কিছু পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে এদিন মুখ্যমন্ত্রী টেলিফোনে যোগাযোগ করেছেন। মমতা বলেন, ওখানে ওঁদের চাল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু চাল দিলেও অনেকের হয়তো সবজি কেনার টাকা নেই। সেই জন্য কিছু কিছু পকেটমানি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের গরিবের সরকার। যতটা পারব করব। কিছু লোক চিকিত্সার জন্য কেউ কেউ মাদ্রাজে, কেউ ভেলোরে আটকে আছেন। কেউ বৃন্দাবনে বেড়াতে গিয়ে আটকে পড়েছেন। তাঁদেরও কিছু কিছু সাহায্য করা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, চিন্তা করার কিছু নেই। লোকে ভালো হয়ে যাচ্ছে করোনা আক্রান্ত হলেও।
মুখ্যসচিবের হিসাব অনুযায়ী এই পর্যন্ত সুস্থ হযে বাড়ি ফিরেছেন ৩৭ জন। এই প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ৪০ শতাংশ ভালো করে দিয়েছি। যাঁরা সময়ে এসেছেন, তাঁরা ভালো হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যাঁরা পরে এসেছেন বা ডায়ালিসিস কিংবা অন্য সমস্যা রয়েছে কিংবা মৃত্যুর পর জানা যাচ্ছে করোনা পজিটিভ, তাঁদের বাঁচাব কি করে বলুন। কেউ কি চায় সংখ্যা বাড়াতে? মমতার বক্তব্য, ডাক্তার, নার্সদের কোথাও কোনও গাফিলতি নেই। যাঁরা সমালোচনা করে বেড়াচ্ছে, টিভিতে মুখ দেখাচ্ছে, তাঁরা দিল্লির লোক। কেউ কেউ অন্য মৃত্যুকে কোভিড বলে ব্রেকিং নিউজ দেখিয়ে দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে প্রচ্ছন্নে সংবাদমাধ্যমকে সতর্কও করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কোথায় পেলেন এই তথ্য? খবর খাওয়ানোর কি দরকার? আমরা কিন্তু অ্যাকশন নিতে পারি।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা একনজরে
১. লকডাউনে ছাড়-সেচ, রাস্তা নির্মাণ, জনস্বাস্থ্য, বিল্ডিং নির্মাণ, একশো দিনের কাজ, ইটভাটা, ওয়্যারহাউস, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন
২. ভিন রাজ্যে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের পকেটমানি পাঠানো হবে।
৩. স্বাস্থ্যকর্মীদের হেনস্তা করলে, বাধা দিলে কড়া আইনি ব্যবস্থা।
৪. চিকিত্সক, নার্স ও প্যারামেডিকেল স্টাফদের সাতদিন কাজের পর সাতদিন ছুটি।
৫. পুলিশকেও ছুটি দেওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ।