অনীক দত্ত: অনেকদিন আগে এক দরিদ্র দেশে ফ্লু-এর মহামারি দেখা দিয়েছিল। সেই দেশটি বহু বছর লুটেরাদের দখলে ছিল, মাত্র কিছুদিন আগে মুক্তি পেয়েছে। তাদের না ছিল ডাক্তার, না ওষুধ, হাসপাতাল- কিছুই ছিল না। প্রতিদিন মানুষ মরছে, বুড়ো-বুড়ি-তরুণ-শিশু, কেউ বাদ যাচ্ছে না।
সেই দেশের নেতা ইউরোপ আর আমেরিকার সব দেশের কাছে ডাক্তার, নার্স, ওষুধ সাহায্য চাইলেন। ইউরোপীয়রা সেদিন কোনও সাড়াই দেয়নি। লাতিন আমেরিকার দুয়েকটা দেশ অবশ্য সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই মহা দুর্যোগের কালে সেই দরিদ্র দেশটির তরুণ নেতা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- দেশের প্রতি ২৫ জনের বিপরীতে ১ জন ডাক্তার থাকতে হবে। নইলে স্বাস্থ্যসেবা উপযুক্ত হবে না, দেশটাও বিপদে থাকবে।
তারপর মহা পরাক্রমশালী প্রতিবেশী দেশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই দেশ এগিয়ে চলল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা হল। তার ফলে দেশটা খুবই দ্রুত নিরক্ষরতার অভিশাপমুক্ত হল, শত শত ডাক্তার-নার্স দেশসেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর সেই দেশটার নেতা ঠিক করলেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আয়ত্তে আনতে হবে। মানুষ বাঁচানোর প্রযুক্তি, মানুষ মারার প্রযুক্তি নয়। সব বাধা উপেক্ষা করে দেশটা বায়োটেকনলজি আর জেনেটিক্সে দুর্দান্ত অগ্রগতি অর্জন করল, মেনিনজাইটিস-এর টিকা উদ্ভাবন করল। ক্রমে তারা লাং ক্যানসার-এর চিকিত্সাতেও দারুণ সাফল্য পেল। বর্তমানে তারা ভাইরোলজিতেও ইন্টারফেরন আল্ফা ২বি উদ্ভাবন করেছে। তারপর একদিন সেই দেশের সেই তরুণ নেতা, যিনি এতদিন বাদে বৃদ্ধ হয়েছেন, তিনি দেহ রাখলেন। আর তারপর… নতুন নেতারা দেশের হাল ধরেছেন, কিন্তু নীতির পরিবর্তন হয়নি।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের মহামারি। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আর ধনী দেশগুলি যখন বাঁচার উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন সেই ছোট্ট দেশটি এগিয়ে এসেছে ডাক্তার, নার্স, ওষুধ নিয়ে যে ইউরোপ একদিন তাদের মহা বিপদে ফিরেও তাকায়নি সেই ইউরোপ আজ এই ছোট্ট দেশটির ডাক্তার, ওষুধের আশায় আশায় দিন গুনছে।
এই ছোট্ট দেশটা ওষুধের পেটেন্ট করলেই বিশাল ব্যবসা করতে পারত- করেনি। মানুষের স্বাস্থ্য কোনও ব্যবসার ক্ষেত্র নয়- এটাই তাদের নীতি। এই দেশের নাম কিউবা আর সেই নেতার নাম ফিদেল কাস্ত্রো।
১৩ এপ্রিল, ২০২০। সিপিআই(এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বিবৃতি দিলেন- আইসিএমআর-নাইসেড-এর অধিকর্তা সোমবার সংবাদমাধ্যমে এ রাজ্যে করোনা ভাইরাসজনিত রোগের পরীক্ষা পরিকাঠামো অব্যবহৃত রাখা সম্পর্কে যা বলেছেন তা শুধু উদ্বেগজনকই নয়, কেলেঙ্কারিও। পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তথ্য চাপা দিচ্ছে, যা সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। মুখ্যমন্ত্রীকে এর দায় নিতে হবে এবং রোগ পরীক্ষা প্রক্রিয়া এড়ানোর কাজ বন্ধ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নাইসেড-এর রোগ পরীক্ষা পরিকাঠামোর পূর্ণ ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করোনা মোকাবিলায় রোগ পরীক্ষায় স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত না করা হলে আমরা বাধ্য হব লকডাউনের নিযমবিধি মান্য করেই প্রতিবাদে নামতে।
কিন্তু তিনি কি শুনতে পেলেন? কানে পৌঁছোল কিছু! সামান্য অপ্রাসঙ্গিক হলেও ২০১২-র ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে। সেই ভদ্রলোকের কথা কারও মনে আছে? বিক্ষোভে অংশগ্রহণের অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া এক আণবিক জীববিজ্ঞানী, যিনি ১০ দিন জেলে থাকার পর মুক্ত হয়েছিলেন। কলকাতায় বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় সে বছর ৪ এপ্রিল পার্থসারথি রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ তিনি বলেছিলেন, ৪ এপ্রিল প্রতিবাদের দিন তিনি শহরে ছিলেন না। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ভারত ও বিদেশ থেকে ৫০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-কে হস্তক্ষেপ করতে বলেছিলেন সেদিন।
পার্থসারথি রায় কে? একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী অধ্যাপক, যাঁর কাজ সারা বিশ্বের সম্মানজনক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে বহুবার। অথচ বিক্ষোভের সময় পুলিশ তাঁকে লাঞ্ছিত করে, কিন্তু সে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। তাঁর আইনজীবীরা বলেছিলেন, তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণাগার ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এ ওই প্রতিবাদের দিন একটি সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন। তাঁরা এ-ও জানিয়েছিলেন, পার্থসারথি রাত পর্যন্ত সেখানে ছিলেন, এমনকি পরের দিনও সেখানে তিনি ছিলেন।
গ্রেপ্তারের নিন্দা করা হয়েছিল সর্বত্র। নিন্দা করেছিলেন সেইসব বিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদ, যাঁরা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে লিখেছিলেন অধ্যাপকের মুক্তির জন্য হস্তক্ষেপ করতে। যে আবেদনে সই করেছিলেন অরুণা রায়, নিখিল দে, নোয়াম চমস্কি, মৃগাঙ্ক সুর, আভা সুর সহ অন্য প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব। শুধুমাত্র এ রাজ্যে এ ধরনের ধারাবাহিক ঘটনা নয, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও বিষয়টির যে প্রভাব আছে ভীষণরকম, চিঠিতে তারও উল্লেখ করা হয়েছিল।
উল্লেখের কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্য সরকার সম্প্রতি তার সমালোচকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক নেতিবাচক প্রচার চালাচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা হয়েছিল, পুলিশ কলকাতায় একজন অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করেছে ইন্টারনেটে কার্টুন পোস্ট করার অভিযোগে, যা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে উপহাস করার শামিল। মনে করিয়ে দিই, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালযে রসায়ন পড়ানো অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, যাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল একটি নিছক কার্টুন ফরওয়ার্ড করার অভিযোগে। পরে অবশ্য তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন।
মনে করিয়ে দিই, রাজ্যের ৩৪ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছিলেন। এবং তারপর বর্তমানে আমরা এমন এক সময়ে মধ্য দিয়ে চলেছি, যখন বুক ঠুকে লড়াই করার সময়। অত্যন্ত সীমিত সম্পদ আমাদের, বিশেষ করে চিকিত্সা বিষয়ে সারা বিশ্ব টালমাটাল। আমরাও করোনা মহামারিতে ক্রমশ বিপর্যস্ত হচ্ছি। অথচ এ রাজ্যের হাল ক্রমশ বেহাল। কেরালাকে আমরা দেখে শিখছি না বিন্দুমাত্র। এখানে করোনা রোগী বিষযে তথ্য নিয়ে অসম্ভব রকম ধোঁয়াশা। কেন এত তথ্য গোপনের চেষ্টা? মানছি, আমাদের সীমিত শক্তি, তবুও লড়াইটা তো লড়তে হবে। কিউবার মতো দেশ যদি পারে, আর আমরা… এর দ্বারা কী প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী?
জাতীয় গণমাধ্যম এসব প্রশ্ন করছে। বহু চিকিত্সক ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের হতাশা প্রকাশ করছেন, কিন্তু সরকারের কাজের বিরুদ্ধে সেভাবে রা কাড়ছেন না। অম্বিকেশ মহাপাত্র তার সার্থক উদাহরণ। বিরোধীরা প্রতিবাদ করছে, কিন্তু সেই প্রতিবাদে শামিল হওয়ার মতো জনগণকেও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা রাজনীতি করার সময় নয়। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, হাসপাতালে হাসপাতালে নার্সরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, প্রয়োজনীয় রসদটুকু না পাওয়ার জন্য, অথচ বলা হচ্ছে সবই নাকি হাতের কাছে মজুত! কেউ কি এই বিভ্রান্তি পরিষ্কার করতে পারবে? আমাদের কি জানার অধিকার নেই? সরকারের কাছে অনুরোধ করব, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঠিকমাত্রায় জোগান দিতে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে করোনা পরীক্ষার জন্য যে প্রয়োজনীয় কিটের জোগান দেওয়া হচ্ছে, তার সদ্ব্যবহার করতে। প্রশাসনও যাতে চারপাশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখে, সে দিকটাও দেখতে হবে বইকি! গণতান্ত্রিক উপায়ে সবটুকু সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছাক, ভীষণরকম চাই। জরুরি অবস্থায় কে কোন দলের, সেটা যেন কোনওভাবেই বিবেচনায় না আসে।
সবশেষে বলব, দয়া করে বাড়িতে থাকুন এবং নিরাপদে থাকুন। কোনও ভুল করবেন না। আপনার প্রিয়জনকে হয়তো অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কারণ ভাইরাস তাঁকে বা তাঁদের আক্রমণ করেছে। আপনার যতই ঘনিষ্ঠ হোন না কেন, দয়া করে তাঁর কাছে আপনি যাবেন না। বারবার একটি কথা মাথায় রাখুন, আপনি যত ঘরে থাকবেন, পৃথিবীটা তত দ্রুত ক্ষতমুক্ত হবে। আপনার অবিবেচক কাজে এমনটা যেন না হয়, হাসপাতালের বিছানায় শুযে থাকা মানুষটির আপনি হাত ধরতে পারবেন না। ভেন্টিলেটারের মাধ্যমে শ্বাস নেওয়ার দিন হয়তো বা ক্রমশ কমে আসবে তাঁর…! যাঁর কাছে যাওয়ার অধিকার থাকবে শুধুমাত্র হাসপাতালের কর্মীদের। হাসপাতালের অক্লান্ত সেইসব সাহসী যোদ্ধাকে আমার কুর্নিশ।
শুধু দয়া করে বাড়িতে থাকুন এবং শুধুমাত্র প্রয়োজন হলে বাইরে যান। আপনার পরিবার এবং আমার জন্য সামাজিক বিভেদ এখন অপরিহার্য। একইসঙ্গে অপরিহার্য সংক্রমণ না লুকিয়ে তথ্য গোপন না করে সরকারের উচিত মানুষকে যাবতীয় সংকট থেকে মুক্ত করা। আবারও বলছি, এটা রাজনীতি করার সময় নয়। কিউবা, কেরলকে দেখে কবে শিখবে এ রাজ্যের সরকার!