শুভদীপ শর্মা, লাটাগুড়ি : কাজ বলতে ছিল জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ। সেখান থেকে একলাফে একেবারে দক্ষ হস্তশিল্পী। তাঁদের তৈরি হাতি-গন্ডার শোভা পাচ্ছে বহু মানুষের ড্রযিংরুমে। গরুমারা জঙ্গল লাগোয়া বিচাভাঙ্গা বনবস্তির তুলসী, ললিতা, বিমলাদের এই উত্তরণ সম্ভব হয়েছে বন দপ্তরের সৌজন্যে। স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি ধুঁকতে থাকা পরিবারকেও অনেকটা নিশ্চিন্ত করেছেন তুলসীরা। বন দপ্তরের এই উদ্যোগ গোটা রাজ্যে মডেল হয়ে উঠতে পারে।
২০০২ সালে বন দপ্তরের উদ্যোগে গরুমারা জঙ্গল লাগোয়া বিচাভাঙ্গা বনবস্তির মহিলাদের হাতের কাজ শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এর জন্য একজন শিক্ষিকাও নিয়োগ করা হয়। হস্তশিল্পের কাজ শিখে বর্তমানে স্বাবলম্বী বিচাভাঙ্গা বনবস্তির প্রায় ৪৫ জন মহিলা। ঘর-গেরস্থালির কাজ সামলে হাতের কাজ করে অর্থ উপার্জনে ঘরের পুরুষদের টেক্কা দিচ্ছেন এই মহিলারা। বিচাভাঙ্গা বনবস্তির তুলসী কোড়া, ললিতা কোড়া, বিমলা কোড়ারা জানান, হাতের কাজ শেখার আগে তাঁরা জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতেন। সংসারও সচ্ছল ছিল না। তবে এখন হাতের কাজ শেখার পর তাঁরা প্রতি মাসে গড়ে তিন-চার হাজার টাকা রোজগার করছেন। বর্তমানে অনেকটাই সচ্ছল তাঁদের সংসার। গরুমারার গাইড ধীরেন কোড়া বলেন, গাইডগিরি করে যা আয় হত, তাতে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হত। এখন মেয়ে হাতের কাজ শিখে আয় করছে। সংসারের হাল অনেকটাই ফিরেছে।
মূলত পাট দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন ললিতারা। পাট দিয়ে নানা বন্যপ্রাণী যেমন হাতি, গন্ডার, ময়ূর তৈরি করেন বনবস্তির এই মহিলারা। তারই পাশাপাশি তৈরি করেন পাপোশ, ব্যাগ। এই সমস্ত সামগ্রী বন দপ্তর কিনে নিয়ে গরুমারায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের স্মারক হিসেবে দেয়। স্ক্রিন প্রিন্টিং, ল্যামিনেশনের কাজেও দক্ষ হয়ে উঠেছেন বনবস্তির মহিলারা। গরুমারায় পর্যটকদের জঙ্গলের লোগো দেওয়া হয়। এই লোগোর ল্যামিনেশন ললিতারাই করেন। এছাড়া পর্যটক আবাসের বেডকভার, বালিশের কভারে গরুমারার লোগোর স্ক্রিন প্রিন্টিং করেন মহিলারা। হাতের কাজ শিখে গ্রামের বয়স্কদের উপার্জনের পথ খুলে দিয়েছেন বনবস্তির মহিলারা। সবিতা কোড়া, পুষ্প কোড়া, মধুরানি কোড়ারা জানান, পাট দিয়ে যে সামগ্রী তৈরি হয় তার জন্য প্রথমে পাটের বিনুনি তৈরি করতে হয়। এই বিনুনি তৈরির কাজ গ্রামের আরও অনেককে শিখিয়েছেন তাঁরা। সবিতাদের কাছ থেকে কাজ শিখে ১০০ হাত বিনুনি ২০ টাকার বিনিময়ে তাঁদের কাছেই বিক্রি করছেন রত্নে চেরিয়া, পেতিনি ওরাওঁ, লোহিয়া খেরিয়ার মতো ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধরা।
বনবস্তির মহিলাদের হস্তশিল্পের প্রশিক্ষক সরস্বতী বণিক বলেন, এঁরা প্রত্যেকেই দক্ষ হস্তশিল্পী হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি স্ক্রিন প্রিন্টিং, ল্যামিনেশনও করায়ত্ত করে নিয়েছেন। এঁরা সবাই এখন স্বাবলম্বী। গরুমারা বন্যপ্রাণ বিভাগের ডিএফও নিশা গোস্বামী বলেন, প্রতিবছর এই সামগ্রী তৈরি করে বনবস্তির মহিলারা কয়েক লক্ষ টাকা রোজগার করছেন। এই কাজে সরাসরি ৪৫ জন মহিলা যুক্ত রয়েছেন। পাশাপাশি পরোক্ষভাবে বনবস্তির বহু পুরুষ ও মহিলাও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত।